দেশজুড়ে

হয়েছে পুনঃখনন, তবু ভালো নেই কুমার নদ

এক সময় কুমার নদের ভরা যৌবন ছিল। পদ্মার প্রধান শাখা কুমার নদের বুকে এখন হচ্ছে আবাদ। নদীর তীর দখল করেছে প্রভাবশালীরা। গড়ে উঠেছে দোকানঘর ও বাসাবাড়ি। ফলে নাব্য হারিয়েছে। দিনে দিনে আকারে ছোট হয়ে আসছে। ময়লা, আবর্জনা ও বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে। পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কিন্তু পুনঃখননের পরও গতি ফেরেনি এ কুমার নদের।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলায় ১৩টি নদী ও ১৫টি খাল আছে। পদ্মার প্রধান শাখা নদীর মূল প্রবাহ মুখ হচ্ছে মদনখালী মোহনা। কিন্তু পলি পড়ে পানি প্রবেশের উৎস মুখটিই বন্ধ। সদরপুর উপজেলার চরমানাইর, চর হরিরামপুর, মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম ও সদরপুরের ভাটি অঞ্চল, চরভদ্রাসনের পিঁয়াজখালী বাজার এবং হাজিগঞ্জের মোহনা শয়তানখালী থেকে ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পদ্মার বুকজুড়ে জেগে উঠছে প্রায় ২০০টি ডুবোচর।

দেশের অন্যতম বৃহৎ কুমার নদ। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে এর উৎপত্তি। এটি ফরিদপুর হয়ে গোপালগঞ্জের আড়িয়াল খাঁ ও মধুমতী নদীতে গিয়ে মিশেছে। এটি প্রায় ১২৪ কিলোমিটার লম্বা। ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও গতি ফেরেনি কুমার নদের। নদী পুনঃখনন কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীটিকে একটি বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। তবে কাজ শেষেও নদীতীরের দুপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, খনন কাজের সময় নদী তীরে ধস নামায় পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কুমারের প্রায় দুই কিলোমিটার পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করা যায়নি। শহরের বাইরে যেসব স্থানে খনন হয়েছে, এরইমধ্যে সেখানকার অনেক জায়গায় মাঝনদীতে চর পড়ে গেছে। কিছু অংশে খাড়াভাবে ভেকু দিয়ে খনন করায় নদীর তীর দেবে গেছে। এসব কারণে দেশের অন্যতম এই বৃহৎ নদীটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

Advertisement

ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরের কুমার নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭১ কিলোমিটার অংশ সংস্কারে একটি প্রকল্প নেয়। কাজটি খুলনা শিপইয়ার্ড পাওয়ার পরে সেটি সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে বাস্তবায়ন করে বেঙ্গল গ্রুপের ফিউচার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামে একটা প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়।

পুন:খনন ছাড়াও নদীতে গোসলের জন্য বিভিন্নস্থানে ৬১টি পাকা ঘাট ও নারীদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য ঘাটের পাশে ঘর নির্মাণ করে পর্যায়ক্রমে নদীকে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে কুমার নদে ১০ কোটি ঘনমিটার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার কথা। এতে ২৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দিয়ে ৩৪ হাজার ১০৪ হেক্টর টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুমার নদ পুনঃখননে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় অবৈধ দখলদারদের কারণে। ফরিদপুর পৌর শহরের ভেতরে নদীর ৯ কিলোমিটার অংশের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখলদারদের কবলে চলে গেছে। দুপাড়ে হাজারো স্থাপনা গড়ে উঠেছে। মদনখালী রেগুলেটরের কাছে উৎস মুখ থেকে শুরু হয়েছে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকা পর্যন্ত সর্বত্র দখলের চিহ্ন। মদনখালী রেগুলেটর, চুনাঘাটা, অম্বিকাপুর, আলীপুর, শরীয়তুল্লাহ বাজার, পশ্চিম খাবাসপুর, পূর্ব খাবাসপুর, চর কমলাপুর ও বিলমামুদপুরে নদের দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা চলে গেছে দখলদারদের কবজায়। এরমধ্যে অনেক জায়গা সিঅ্যান্ডবি, পৌরসভা কিংবা জেলা পরিষদের মালিকানাও আছে। যেগুলো অপসারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

বাজার হাজি শরিয়তুল্লাহ বাজার ও সরকারি তিতুমীর বাজারের নিত্যদিনের বর্জ্য ফেলা হয় কুমার নদে। নদী দখল করে বসতবাড়ি, দোকানপাট ও মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ইটভাটা, বেকারিসহ ছোট ও মাঝারি কারখানা এমনকি পৌরসভার গণশৌচাগারও। বাজার এলাকায় কাঁচা শাকসবজির বর্জ্য, কারখানার বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, গেরস্থালী বর্জ্যসহ হেন কোনো আবর্জনা নেই, যা কুমারের বুকে ফেলা হচ্ছে না। সারা শহর থেকে বয়ে আনা পৌরসভার ড্রেনের বড় ছয়টি মুখ দিয়ে ফেলা হচ্ছে কুমার নদে। এসব ড্রেনের সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ির পয়োনালার সংযোগ থাকায় মলমূত্রও এসে পড়ছে নদীতে।

Advertisement

স্থানীয়দের অভিযোগ, খননযন্ত্র বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হচ্ছে নদীর গহ্বর থেকে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানা জমে এঁদো ডোবার মতো হয়েছে কুমারের চেহারা। শহরের আলিমুজ্জামান বেইলি ব্রিজ থেকে পশ্চিম খাবাসপুর নার্স ইনস্টিটিউট পর্যন্ত কুমার নদের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পরিণত হয়েছে মশার জন্মস্থানে। মাঝে মাঝে নদে মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনাও ঘটছে। নদী পুনঃখনন প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নের পরও এর উন্নয়ন হয়নি।

বোয়ালমারীর দাদপুর এলাকার কৃষক বাবুল মোল্লা বলেন, অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে নদী ও খালের যৌবন হারিয়ে যাওয়ার পথে। এখন আর নদীতে আগের মতো সারা বছর পানি থাকে না। নদী-খালগুলো দিন দিন ছোট হওয়ার পাশাপাশি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর বুক জুড়ে ধান চাষ করা হয়েছে। চৈত্র মাসে নদীর বুকে ফুটবল খেলে। নদী ও খাল রক্ষা করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

ফরিদপুর পৌর শহরের আলীপুরের বাসিন্দা ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য সঞ্জীব দাস বলেন, শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদ বিপুল ময়লা-আবর্জনা আর দখলে দূষিত হয়ে উঠেছে। শহরের ব্যস্ততম এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ কুমার নদের ঘাটগুলো যেন এখন বাজার ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে উঠেছে।

ফরিদপুর জর্জ কোর্টের আইনজীবী সেলিমুজ্জামান রুকু জাগো নিউজকে বলেন, নদ-নদীগুলো প্রাকৃতিকভাবে যতটুকু নাব্যতা হারাচ্ছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃত্রিমভাবে। মনুষ্যহীন কিছু লোভী মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নদীর গতিরোধ করে বাঁধ, নদীগর্ভ ভরাট করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছে। যা খুবই দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। আইন প্রয়োগ করা উচিত।

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা জাগো নিউজকে বলেন, কুমার নদ ফরিদপুরবাসীর জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ নদকে ঘিরে ফরিদপুরবাসী অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে কুমার নদ পুনঃখননে প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল কিন্তু কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাই ফরিদপুরবাসীর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। ফরিদপুরবাসীর প্রত্যাশা এই নদটি পুনঃখনন ও সংস্কার করে নাব্য বজায় রাখা হোক এবং স্রোতস্বিনী ধারা হিসেবে তার পূর্বের রূপ ফিরে পায় সেই ব্যবস্থা করা হোক।

এ বিষয়ে ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস জাগো নিউজকে বলেন, শহরের বুকে কুমার নদে বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য না ফেলার জন্য আমরা নদীর পাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছি। বিভিন্ন কলকারখানা ও বাসাবাড়ির যেসব বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারেও চেষ্টা চলছে যাতে এভাবে নদীতে না ফেলতে পারে। কিছু প্রভাবশালীর বাসাবাড়ির ড্রেনও এরইমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছি। আর শহরের ড্রেনের মুখগুলোর বিকল্প পথ খুঁজে বের করার বিষয়টি অর্থসাপেক্ষে বাস্তবায়নের বিষয়। এ বিষয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা আছে।

ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা জাগো নিউজকে বলেন, কুমার নদ পুনঃখনন প্রকল্পের কাজ শেষ। এখন নদীর ঘটনা নির্মাণসহ কিছু কাজ অবশিষ্ট আছে। শহরের মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার কাজ করতে যেয়ে নদী তীর ধসের ঘটনা ঘটে। এ কারণে এ অংশে পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন করা যায়নি।

নদীর দুই তীরে দখলদারদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প শুরুর পর আমরা মেপে দেখতে পাই এসব স্থাপনা পৌরসভা, সিঅ্যান্ডবি কিংবা অন্যকোনো বিভাগের। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা নেই। এরপরও বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। ফের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।

এসজে/এমএস