অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) মিয়া নুর উদ্দিন আহমেদ অপুর জামিনের পক্ষে শুনানিতে দাঁড়িয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো.কামরুল ইসলাম।
Advertisement
কামরুল ইসলাম ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। এর আগে তিনি আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। সমালোচনাকারীরা বলছেন— পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তিনি তারেক রহমানের এপিএসের জামিনের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন না। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর দাবি— আসামি নুরউদ্দিন আহমেদ অপু যে তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন তা তিনি জানতেন না। বিএনপি থেকে জাতীয় নির্বাচন করার কথা উল্লেখ থাকলেও মক্কেল অপু যে তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন তা মামলার কোথাও উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রপক্ষও শুনানিতে তা উল্লেখ করেনি।
অপুর জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য সোমবার (১৩ মার্চ) বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চে ওঠে।
Advertisement
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে শুনানি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী। আর নুরউদ্দিন আহমেদ অপুর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো.কামরুল ইসলাম। এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন। শুনানির পর আদালত মঙ্গলবার আদেশের জন্য রেখেছেন।
যে দুই মামলায় জামিন শুনানি:২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলা করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মামলায় ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) এবং ২০১৩ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৭ ও ৩০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে মতিঝিল সিটি সেন্টারে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ এবং ইউনাইটেড করপোরেশনের অফিসে বিপুল পরিমাণ অর্থ মজুতের অভিযোগ পায় র্যাব-৩। সংবাদ পেয়ে ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে এ এম হায়দার আলীকে আটক করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে তিন কোটি ১০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। একই কাজে ব্যবহারের জন্য আরও পাঁচ কোটি টাকা মানিটারি এক্সপ্রেস অফিসে রেখে আসার কথা স্বীকার করেন হায়দার আলী।
ওই ঘটনায় ছয়জনসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা হয়। আসামিরা হলেন- এএম আলী হায়দার নাফিজ, জয়নাল আবেদীন, আলমগীর হোসেন, মিয়া নুর উদ্দিন আহমেদ অপু, আতিকুর রহমান আতিক ও মাহমুদুল হাসান। পরে অভিযোগপত্রে ছয়জনের সঙ্গে ফয়েজুর রহমানের নামও যুক্ত করা হয়।
Advertisement
আসামি মিয়া নুর উদ্দিন আহমেদ অপু তারেক রহমানের এপিএস ও শরীয়তপুর-৩ আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন। আসামিদের মধ্যে আতিকুর রহমান আতিক ও মাহমুদুল হাসান শুরু থেকেই পলাতক। ফয়েজুর রহমান উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পলাতক। আর নাফিজ ঘটনার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ মামলায় ২০২১ সালের ১৩ জুন সাতজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় র্যাব। একই বছর ১২ আগস্ট মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়। ট্রাইব্যুনাল ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে পলাতক তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে আছেন অপু। এ দুই মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টে এসে জামিন চান অপু। পরে গত বছরের ২ ডিসেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় অপুকে জামিন দেন হাইকোর্ট। আর অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের মামলায় জামিন হয় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম।
পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত বছর ৫ ডিসেম্বর ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তার জামিন স্থগিত করে চেম্বারজজ আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন দুটি আপিল বিভাগের নিয়মিত পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ অপুর জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। আবেদন দুটি সোমবার বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে শুনানি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী। আর নুর উদ্দিন আহমেদ অপুর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন। শুনানির পর আদালত আজ মঙ্গলবার আদেশের জন্য রেখেছেন।
শুনানির পর আদালত থেকে বেরিয়েই রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবী ঘিরে ধরেন মো. কামরুল ইসলামকে। আসামির অপরাধের গুরুত্ব তুলে ধরে কামরুল ইসলামকে বলতে থাকেন, ‘আপনি এ আসামির পক্ষে দাঁড়াতে পারেন না। আপনার আদর্শের সঙ্গে যায় না।’ তখন কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে সেখান থেকে চলে আসেন আইনজীবী মো.কামরুল ইসলাম।
আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আইনজীবী হিসেবে মো. কামরুল ইসলামের আলাদা একটা পরিচিতি আছে। তিনি যেকোনো মামলা লড়তে পারেন। এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আদর্শ বলে একটা ব্যাপার থাকে। দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা ব্যাপার থাকে। দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাপারটা সবসময় পেশাগত নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না বা পড়লেও অনেকে অনেকভাবে মানিয়ে নেন। কিন্তু আদর্শগত ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আদর্শগত বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। যদিও পেশা হিসেবে আইনজীবীদের নির্দিষ্ট সীমানা নেই। কিন্তু যারা সংসদ সদস্য, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেছেন বা করছেন, তারা তো দেশ জাতির অহংকার। তাদের কাছে দেশ-জাতির অনেক প্রত্যাশা থাকে। কাজেই যারা সিনিয়র আইনজীবী, তারা যদি আদর্শগত দিকটা বজায় রাখেন তাহলে আমাদের নীতি-নৈতিকতার মানটা আরও বাড়বে।’
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মিয়া নুর উদ্দিন আহমেদ অপু নামে বিএনপির এক নেতার একটি মামলা লড়ছি। তিনি আমাদের কনিষ্ঠ এক আইনজীবীর সহোদর। মামলাটি প্রয়াত অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর লড়তেন। এ মামলার কোথাও লেখা নেই নুর উদ্দিন আহমেদ অপু তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন বা গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। মামলার কোনো জায়গায় এ বিষয়ে একটা শব্দও নেই। রাষ্ট্রপক্ষও বলেননি তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন উনি।
বিএনপি নেতাদের সমালোচনায় সবসময় উচ্চকণ্ঠ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে যখন জামিনের বিরোধিতা করে অতিরিক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল আপত্তি জানিয়েছেন, তখনো তিনি কিন্তু আদালতে বলেননি এ ব্যক্তি তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন। আদেশের পর আদালতের বাইরে এসে আমাকে বলেছেন, আসামি তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন।’
তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন জানলে নীতিগতভাবে এ মামলাটা তিনি লড়তেন না জানিয়ে বলেন, ‘হাইকোর্টে আমি এ মামলায় জামিন করিয়েছি। চার বছরের ওপরে তিনি কারাগারে আছেন। মামলাটা করেছি একজন সাধারণ মক্কেল হিসেবে। আব্দুল মতিন খসরুও এ মামলা করেছেন। যদি জানতাম আসামি মিয়া নুরউদ্দিন আহমেদ অপু তারেক রহমানের এপিএস ছিলেন তাহলে আমি এ মামলা লড়তাম না।’
এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামীপন্থি এক সিনিয়র আইনজীবী নামপ্রকাশ না করার শর্তে কামরুল ইসলামের সমালোচনা করে বলেন, ‘আদর্শের কথা বাদই দিলাম, পেশাগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তিনি এ মামলা লড়তে পারেন না। খুবই দৃষ্টিকটু।
এফএইচ/এমএএইচ/জিকেএস