গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার সংলগ্ন এলাকায় বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি নির্মাণে নিয়ম মানা হয়নি। পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়া হলেও প্রথম তিনতলা বাণিজ্যিক এবং বাকি চারতলা আবাসিকসহ মোট সাততলা ভবন ব্যবহার হয়ে আসছিল।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করা মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভবনের প্ল্যান বাতিল করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্স ও ইউটিলিটির মতো প্রয়োজনীয় সংযোগ বাতিল করতে পারলে এ ধরনের ভবন গড়ে তুলতে নিরুৎসাহিত হবেন মালিকরা।
সম্প্রতি গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবনের অবস্থা তদন্ত করে ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে কি না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রোববার (১২ মার্চ) ছয় সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এরই মধ্যে গঠিত এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ভবন নির্মাণে নিয়ম মানা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জেনেছি এটা একটি পাঁচতলা কমার্শিয়াল বিল্ডিয়ের (বাণিজ্যিক ভবন) অনুমোদন নেওয়া ছিল। কিন্তু স্পটে গিয়ে দেখেছি তিনতলা পর্যন্ত কমার্শিয়াল হলেও বাড়তি বাকি চারতলা আবাসিক। এখানে একটা মিক্সড ইউজ চলে এসেছে এবং ভবনটির অনুমোদন ছিল পাঁচতলার করা হয়েছে সাততলা।
Advertisement
প্রথম দিকে মালিক ভবনটি তিনতলা পর্যন্ত করেছিলেন, অনেক বছর পরে এসে তিনি আরও চারতলা করেছেন। তখন যে ইঞ্জিনিয়ার এ ডিজাইন করেছেন বা যারা এগুলো কনস্ট্রাকশনের কাজ করেছেন তারাই মূলত বলতে পারবেন কীভাবে সেটি করলো। আমরা বলতে গেলে এখন ডিটেইলস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করে বুঝতে হবে। এ ভবনটি ১৯৮৩ সালে পারমিশন নেওয়া। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) যে কোড সেটি করেছি ১৯৯৩ সালে। সেসময় হয়তো বিএমবিসি কোড ফলো না করে অন্য কোনো কোড ফলো করেছে।’
তিনি বলেন, 'আগুন ধরলে বিল্ডিংয়ের স্ট্রেন্থ নষ্ট হয়ে যায়। আগুন ধরার পর বিল্ডিংটা কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে সেটি ডিজাইনে থাকে। সহ্য ক্ষমতার বেশি আগুন ধরলে এটি ধসে পড়বে। বেজমেন্ট থাকে পার্কিংয়ের জন্য, কিন্তু তারা সেখানে টাইলসের দোকান দিয়ে রাখছে।
এছাড়া ঢাকার অন্য জায়গায় দেখা যাবে বেজমেন্ট গোডাউন করছে, মালামাল রাখছে। রাজউকের কাজ বিল্ডিংয়ের অনুমোদন দেওয়া, অনুমোদন অনুযায়ী বিল্ডিং না করলে তাকে নোটিশ দেওয়া বা কাজে বাধা দেওয়া। রাজউকের অনুমোদন না থাকলে কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার কথা নয়, বিদ্যুৎ-পানির কানেকশন পাওয়ার কথা নয়। বেজমেন্ট ক্লিয়ার করে ভবনে আলো-বাতাস ঢুকতে দিতে হবে। বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কথা বলে গুদাম নির্মাণ করলে তো নিয়ম মানা হলো না।
গঠিত তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবনটি বিস্ফোরণের পর যেহেতু মালিককে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই রাজউক একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুইদিনের মধ্যে পাইপ নিয়ে যে নয়টি কলাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোকে স্টেবল করেছে। যে কংক্রিট নষ্ট ছিল সেগুলোও কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। তবে ভবনটি হেলে পড়েনি। কোনোধরনের রিপোর্ট না থাকায় পাশের ভবনগুলোর কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা সেটি দেখেনি কমিটি।
Advertisement
যা সুপারিশ করলো কমিটিগত ৮ মার্চ ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শন করে তদন্ত কমিটি। পরিদর্শনকালে দেখা যায়- ভবনটি বীম-কলাম মুভমেন্ট রেজিস্টার সিস্টেম এবং ভবনটিতে মোট ২৪টি কলাম রয়েছে। বিস্ফোরণের ফলে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মোট ২৪টি কলামের মধ্যে নয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বেইজমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্লাব ও বিমসহ রিটেইনিং ওয়ালের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণে ভবনের কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বর্তমানে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-উদ্ধারকারী বাহিনীর মাধ্যমে ভবনটি কর্ডন (অস্থায়ী বেড়া) করে রাখা হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কয়েকটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সুপারিশগুলো হলো-
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংলগ্ন স্থাপনাগুলো এবং রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন ও পথচারীদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত বিম-কলামগুলো অতিদ্রুত প্রপিং সাপোর্ট দিতে হবে। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সম্মুখে ফুটপাতসহ রাস্তার দিকে ২৬ ফুট পর্যন্ত জায়গা কংক্রিট অথবা স্টিল রোড ব্যারিকেড দ্বারা কর্ডন করে রাখতে হবে এবং প্লটের সামনের রাস্তার ট্রাফিক ভলিউম বিবেচনায় সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাসসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া যেতে পারে। তবে, রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত এ রাস্তায় সব যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হবে।
ভবন মালিকপক্ষের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মাধ্যমে ১৮০/১ নম্বর সিদ্দিক বাজারে অবস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান (ডিইএ) আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
ভবন মালিক পক্ষের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মাধ্যমে ডিইএ রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় রিট্রোফিটিংয়ের কাজ আগামী ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা না পর্যন্ত ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। তবে থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিইএ এবং রিট্রোফিটিংয়ের সার্টিফিকেট প্রদানের পর ভবনটি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা জাগো নিউজকে বলেন, বিল্ডিংটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সেদিন রাতেই আমি গিয়েছি, আমার টিম গিয়েছে। পরদিন আমরা একটা কারিগরি কমিটি করে দিয়েছিলাম, কারণ এ বিল্ডিংটি এ মূহুর্তে ঝুঁকিপূর্ণ কি না। প্রাথমিকভাবে আমাদের কারিগরি টিম জানিয়েছে, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা সেটি যাচাইয়ের জন্য যে সময় নিয়ে অ্যাসেস করতে হবে সেই সময়ে এটা নিরাপদ নয়। কারণ ২৪টি কলামের মধ্যে ৯টি কলামই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই কলামগুলোতে রেক্টোফিটিংয়ের মাধ্যমে সাময়িকভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা হয়েছে। কারণ যারা এ ভবনটি নিয়ে কাজ করবে তারা যেন নিরাপদ থাকে সেজন্যই এটা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করলে বুঝা যাবে ভবনটি ফাইনালি ভেঙে ফেলতে হবে নাকি ব্যবহার উপযোগী থাকবে। তদন্ত কমিটি পরামর্শ দিয়েছে অ্যাসেসমেন্ট করার আগ পর্যন্ত ২৬ ফিট জায়গা খালি রাখতে হবে, গভীর রাতে যানবাহন না চলার। আমরা বিষয়টি সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে জানিয়ে দেবো।
গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারের নর্থসাউথ রোডে সাততলা ওই ভবনে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ভবনটির তিনতলা পর্যন্ত পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে স্যানিটারি ও গৃহস্থালি সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। বিস্ফোরণে ভবনটির দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে পড়ে যায়। ভবনের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশের কয়েকটি ভবনও।
আইএইচআর/এমএএইচ/এএসএম