জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত মফস্বল গোপীনাথপুর। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার দিন থেকে মেলাটি শুরু হয়। এবার ১৩ দিন চলবে মেলাটি। ৭ মার্চ শুরু হয়ে মেলা চলবে ১৯ মার্চ পর্যন্ত।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ গোপীনাথপুরে বেড়াতে আসেন। তখন এখানে নন্দিনী প্রিয়া নামে এক সাধকের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব ওই সাধককে প্রায় ৬০৪ একর জমি লাখেরাজ দান করে দিয়ে যান। যার উৎস থেকে প্রতি বছর দোলযাত্রা ও মেলা উৎসব চলে আসছে।
মেলার আয়োজক কমিটির একাধিক সদস্য জানায়, গোপীনাথপুর মন্দির ঘিরে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে থেকে দোলপূর্ণিমার দিনে মেলা বসে। তবে মেলায় ঘোড়ার হাট বসছে ৪০-৫০ বছর ধরে। দেশের একমাত্র ঘোড়া বিকিকিনির হাট এটি। এ কারণে সারা দেশ থেকে আনা কয়েক হাজার ঘোড়া জড়ো করা হয়। কয়েক বছর ধরে মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল যাত্রা-সার্কাস। তবে এবার মেলায় যাত্রা-সার্কাস না আসলেও ভ্রাম্যমাণ নৌকা, নাগরদোলা, ট্রেন, জাম্পিং, সাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রদর্শনী এসেছে।
আরও পড়ুন: ভৈষা দই মেলা
Advertisement
মেলায় মহারাজা, বাদশা, কদমরানী, রাজ, বিজলী, কিরণমালা, বারুদ, ডলামনি, সুন্দরী বাহাদুর, তাজিয়া, বিজলি, কিরনমালা, রাজা, রানী, সুইটি আরও কত দেশী-বিদেশি বাহারি নামের ঘোড়া। ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায় মেলে ওদের নামের সার্থকতা। ঘোড়াগুলোর চলনে বিদ্যুৎগতি, চোখের পলকে মাইল পার হওয়ায় জুড়ি নেই।
এবার মেলার ঘোড়ার হাটে প্রতিদিন উঠছে প্রায় দুই হাজারের বেশি ঘোড়া। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শতাধিক ঘোড়া। এবারও নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া মেলায় এসেছে। তবে এবার মেলায় ছোট আকারের ও মাঝারি আকারের ঘোড়া বেশি এসেছে।
মেলায় পশ্চিম-পূর্ব পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে বসেছে গরু-মহিষের হাট। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গরু, মহিষ ও গাড়ল নিয়ে এসেছেন বিক্রেতারা। সেগুলো দেখতে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে।
এবার মেলায় দুটি ঘোড়া ভারত থেকে আমদানি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা আবু বক্কর সিদ্দিক। লাল-সাদা রঙের মহারাজা, সাদা-কলো রঙের বাদশা। মহারাজা সাত লাখ টাকা ও বাদশার দাম ৬ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
Advertisement
আয়োজক সূত্র জানায়, বর্তমানে ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘোড় সওয়ারি ও ঘোড়া মালিকরা এ মেলায় আসেন। দোল শুরুর আগে থেকেই মেলায় বিভিন্ন দোকান-পাট বসতে শুরু করে।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে এসেছেন আবু সায়েম সরকার। তিনি বলেন, পূর্ব পুরুষ থেকে ঘোড়া পালন করে আসছি। ৩০ বছর ধরে এ মেলা করছি। মেলায় সাদা কাজলা ও লাল কাজলা রঙের দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। সাদা কাজলার দাম এক লাখ ৬০ হাজার ও লাল কাজলার দাম এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
নওগাঁর ধামুরহাট থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন শাহরিয়ার ইসলাম। লাল ও সাদা রঙের ঘোড়াটা দেখতে অনেক সুন্দর। ঘোড়ার নাম রেখেছেন কদমরানী, আরেকটার নাম বারুদ। তিনি বলেন, কদমানীর দাম আড়াই লাখ টাকা ও বারুদের দাম ৭০ হাজার টাকা হাঁকিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কদমরানীর দাম এক লাখ ৬০ হাজার টাকা ও বারুদের দাম ৫০ হাজার টাকা উঠেছে।
বগুড়ার সান্তাহার থেকে এসেছেন রাসেল হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় ঘোড়ার হাটে এসেছি। ৫২ হাজার টাকায় একটি মাঝারি আকারে ঘোড়া কিনে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ঘোড়ার নাম বললেন সুন্দরী।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার নলডুবি গ্রামের জয়নাল আবেদীন বলেন, ঘোড়া কিনতে এসেছি। দরদামে হয়ে গেলে ঘোড়া কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরবো।
আরও পড়ুন: ক্রেতা-উদ্যোক্তাদের ভিড়ে মুখরিত এসএমই পণ্য মেলা
নওগাঁর মহাদেবপুর থেকে ছয়টি মহিষ নিয়ে এসেছেন রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মেলা ১৮ বছর ধরে করছি। এখন পর্যন্ত এক জোড়া মহিষের দাম ওঠেছে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
মেলায় সবচেয়ে বড় মহিষ নিয়ে এসেছেন রাজশাহীর ইউসুফপুরের মাইনুল ইসলাম মিন্টু। তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এ মেলা করছেন। এবার বড় তিনটি ও ছোট আকারের ৪০টি মহিষ নিয়ে এসেছেন। বড় একজোড়া মহিষের দাম হাঁকিয়েছেন ১৫ লাখ টাকা।
গোপীনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, মেলায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটিও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। মেলায় নিরাপত্তার জন্য অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসেছে।
জয়পুরহাট পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ নূরে আলম বলেন, মেলার নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ যদি ঐতিহ্য বিনষ্টের চেষ্টা করে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
আরএইচ/জিকেএস