গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী। ড. ইউনূসের আগে একমাত্র বাঙালি নোবেল জয়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের কেউ নোবেল জিততে পারেননি, এটা নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আক্ষেপ ছিল। সেই আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন ড. ইউনূস।
Advertisement
তার নোবেল জয়ের মুহূর্তটি আমি কোনোদিন ভুলবো না। ২০০৬ সালে ড. ইউনূসের নোবেল জয়ের খবরটি যখন পাই, তখন আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। উচ্ছ্বাসে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। সব নিয়মনীতি ভেঙে একের পর এক ফোন করতে থাকি। নির্দিষ্ট কোনো কারণে নয়, স্রেফ আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য।
শুধু আমার মধ্যে নয়, ড. ইউনূসের নোবেল জয়ে আনন্দের জোয়ার আসে সারাদেশেই। সত্যিই সেটা ছিল অনন্য এক অর্জন। কিন্তু ড. ইউনূস শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আক্ষেপ হয়েই থাকলেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারেনি, এটা যেমন সত্যি। আবার এটাও সত্যি ড. ইউনূস বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগাননি, যেটা দিয়ে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল।
ড. ইউনূস মূলত একজন অর্থনীতিবিদ। কিন্তু তিনি নোবেল জিতেছেন শান্তিতে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। যখন নোবেল পুরস্কার জেতেন, তখন ড. ইউনূস ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ।
Advertisement
সর্বজন শ্রদ্ধেয় শব্দটি তাঁর নামের আগেই সবচেয়ে মানানসই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে উত্তাল ১/১১’র সময় রাজনীতিতে আসার চেষ্টা তাকে বিতর্কিত করে তোলে। তবে তিনি সবচেয়ে বিতর্কিত হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে। এর পেছনে সরকারের দায় যেমন আছে, ড. ইউনূসের দায়ও কম নয়।
বাংলাদেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্যই অবসরের একটা বয়স আছে। সেই বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় সরকার তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে সরাতে চায়। তখনই গোল বাধে। সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে চাননি ড. ইউনূস। এটা ঠিক, গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূসের হাতে গড়া, তার সন্তানের মতো। কিন্তু তাই বলে তো তিনি সব নিয়মকানুন ভেঙে আজীবন একটি ব্যাংকের এমডি থাকতে পারেন না।
শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে গড়ায়। আদালতের সিদ্ধান্তেই গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হয় তাকে। তখন নিয়ম মেনে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ ছেড়ে দিলে আলোচনার মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকেই আরও কোনো সম্মানজনকভাবে যুক্ত থাকতে পারতেন। সেটা না করে বয়স হওয়ার পরও নিয়ম ভেঙে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ আঁকড়ে থাকার চেষ্টাটা আমার ভালো লাগেনি।
ড. ইউনূস নিজেকে যে উচ্চতায় তুলে নিয়েছিলেন, তার কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিছকই ছোট একটি পদ। যেমন এখন গ্রামীণ ব্যাংকের এখনকার এমডি কে সেটা আমি জানি না। আমার ধারণা, অনেকেই জানেন না। ড. ইউনূস ছিলেন বলেই সে পদটি সম্মানিত ছিল।
Advertisement
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূসের সাথে সরকারের যে দূরত্ব তা কমেনি, বরং কালে কালে তা আরও বেড়েছে। সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান পাননি ড. ইউনূস। বরং নানা সময়ে তাকে হেয় করার চেষ্টা হয়েছে। আবারও ড. ইউনূসও সরকারের সাথে অভিমান করে বাংলাদেশকেই যেন প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেন।
দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার জন্য সরকার বারবার ড. উইনূসকে দায়ী করেছে। এ অভিযোগের সত্যমিথ্যা জানি না, তবে পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সময় ড. ইউনূস তার আন্তর্জাতিক প্রভাব ও পরিচিতি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন, তেমন প্রমাণও পাইনি।
শুধু পদ্মা সেতু নয়, রোহিঙ্গা সংকটেও ড. ইউনূসের বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। সেটাও তিনি করেননি। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের বিপদে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত মুখ ড. ইউনূসকে কখনোই পাওয়া যায়নি। ড. ইউনূস অনেক বড়, কিন্তু দেশের চেয়ে তো নিশ্চয়ই বড় নন, তিনি প্রচলিত আইনেরও ঊর্ধ্বে নন।
অনেকদিন ধরেই ড. ইউনূস কোনো আলোচনায় ছিলেন না। হঠাৎ আবার তিনি আলোচনায় এলেন একটি ‘খোলা চিঠি’কে ঘিরে। এই খোলা চিঠিকে কেউ বলছেন বিবৃতি, কেউ বলছেন বিজ্ঞাপন। কারও কথাই অবশ্য মিথ্যা নয়। বিশ্বের ৪০ জন ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের পক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই খোলা চিঠি লিখেছেন। রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, প্রয়াত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়রের মতো খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা।
মজা হলো, ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও খোলা চিঠিটি গত ৭ মার্চ ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের পুরো পাতা বিজ্ঞাপন হিসেবে। যথারীতি বাংলাদেশের গণমাধ্যম উপেক্ষিত হয়েছে ড. ইউনূসের কাছে।
শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আপনাকে লিখছি, যারা আপনার দেশের জনগণের সাহস ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে। আমরা বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং সমাজসেবী। বিশ্বের কোটি মানুষের মতোই আমরাও বাংলাদেশে বিকশিত ও সারা বিশ্বে অনুসরণ করা উদ্ভাবনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
আপনার দেশের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা থেকেই আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মহান অবদানের পাশে থাকতে ও স্বীকৃতির জন্য ইতিবাচক ব্যবস্থা নিতে আপনাকে অনুরোধ জানিয়ে লিখছি।’
ড. ইউনূসের কৃতিত্ব বর্ণনার জন্য কোনো পত্রিকার এক পৃষ্ঠা যথেষ্ট নয়। তবে এই খোলা চিঠিতে ড. ইউনূসের বিভিন্ন কৃতিত্বের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো আপনার সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে— এমনটা দেখতে পাওয়া বেদনাদায়ক।
আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে চিরায়ত ও সামাজিক উদ্যোক্তারা প্রস্ফুটিত হতে পারেন। আমরা আশা করব, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি প্রাণবন্ত সুশীল সমাজকে লালন করার মধ্য দিয়ে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে বাংলাদেশ তার ভূমিকায় ফিরে আসবে।
এ ক্ষেত্রে প্রথম একটি ভালো উদ্যোগ হওয়া উচিত অধ্যাপক ইউনূসের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাকে নিজ নিরাপত্তায় ব্যস্ত রাখার পরিবর্তে দেশ ও বিশ্বের জন্য আরও ভালো কিছু করতে তার শক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া।’
খোলা চিঠিতে ৪০ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের চাওয়া নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হলো, যখন ড. ইউনূস বাংলাদেশের কোনো ইস্যুতে কোনো আলোচনায়ই নেই, তখন কেন এমন একটি খোলা চিঠি লিখতে হলো। নির্বাচনের বছরে এমন একটি খোলা চিঠি লিখে কি পরোক্ষভাবে সরকারকে চাপ দেওয়া হলো। নাকি ভবিষ্যৎ কোনো আইনি ঝামেলা থেকে ড. ইউনূসকে বাঁচাতেই এই খোলা চিঠি।
ড. ইউনূস সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হলে আমরা অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবো। কিন্তু আইনি বিষয় তো আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত, খোলা চিঠিতে নয়। আর ৪০ জন বিশ্বনেতা চিঠিটি সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে পাঠাতে পারতেন। তা না করে, তারা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন কেন? মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার কাছে লেখা হলেও স্বাক্ষরদাতারা চেয়েছেন, চিঠিটি আরও অনেক বেশি মানুষ পড়ুক।
একটা ছোট প্রশ্ন করে লেখাটা শেষ করি। সাধারণত এ ধরনের খোলা চিঠি বা বিবৃতি বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে একটিমাত্র গণমাধ্যমে তা বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য গণমাধ্যমের সংবাদের উৎস হলো সেই বিজ্ঞাপন। পত্রিকায় দেখলাম, ওয়াশিংটন পোস্টে পুরো পাতা বিজ্ঞাপন ছাপতে প্রায় কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকাটা কি চিঠিতে স্বাক্ষর করা ৪০ জন ভাগ করে দিয়েছেন নাকি ড. ইউনূস একাই দিয়েছেন।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম