ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের এক-তৃতীয়াংশ চরম মাত্রায় নোমোফোবিয়ায় আসক্ত

বর্তমান বিশ্বে ক্রমেই বেড়ে চলা সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি নোমোফোবিয়া। মোবাইল ফোন কাছে না থাকার আতঙ্ককে বলা হয় নোমোফোবিয়া (নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া)। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর সঙ্গে আচরণগত এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার যোগসূত্র আছে। অন্য দেশে বিশেষ এ আসক্তি নিয়ে গবেষণা হলেও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই বললেই চলে।

Advertisement

সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ) চরম মাত্রায় নোমোফোবিয়ায় আসক্ত। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ আসক্তি সবচেয়ে বেশি।

চলতি বছরের মার্চে হেলিয়ন জার্নালে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিলেও একই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ পায়। তবে এবারের নিবন্ধটি আগেরটির তুলনায় কলেবরে বেশ বিস্তৃত।

আরও পড়ুন: চোখের ক্ষতি এড়াতে স্মার্টফোন যেভাবে ব্যবহার করবেন

Advertisement

নিবন্ধটির গবেষকরা হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষার্থী ফিরোজ-আল-মামুন, মোহাম্মদ এ মামুন, মুক্তারুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক তাজউদ্দিন শিকদার, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সালাউজ্জামান প্রধান, নটিংহ্যাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের মার্ক ডি গ্রিফিটস এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার পাবলিক হেলথ বিভাগের মোহাম্মদ মুহিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ৫৮৫ জন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে এতথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় উঠে আসে, মাঝারি মাত্রার নোমোফোবিয়ায় আসক্ত ৫৬ দশমিক এক শতাংশ। আর ৯ দশমিক চার শতাংশ শিক্ষার্থী মৃদু নোমোফোবিয়ায় আসক্ত।

আরও পড়ুন: মোবাইল চুরি হওয়ায় মাইক ভাড়া করে চোরকে গালিগালাজ

Advertisement

গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, স্মার্টফোন প্রাত্যহিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ এবং যুবকদের নিত্যদিনের জীবনে স্মার্টফোন বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে চলছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত এবং অসচেতন ব্যবহার যুবসমাজকে নোমোফোবিয়ার দিকে ধাবিত করে। যেটাকে একধরনের ‘মানসিক সমস্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এতে আরও বলা হয়, বতর্মান বিশ্বে এ আসক্তিটি চোখে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের মধ্যে এটি বেড়েই চলছে। ওমানের একটি জরিপ বলছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের মধ্যে মাঝারি ধরনের নোমোফোবিয়ায় আসক্ত ১৫ শতাংশ। আর চরম হারে আসক্ত ৬৫ শতাংশ।

ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে, ৩৫ দশমিক চার শতাংশ চরমভাবে এবং ৫৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ মাঝারি মাত্রায় আসক্ত। সৌদি আরবে চরম মাত্রায় ২২ দশমিক এক শতাংশ এবং মৃদুমাত্রায় ৬৩ দশমিক দুই শতাংশ।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞাপন দেখিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করছে ১২ অ্যাপ নোমোফোবিয়ার কারণ হিসেবে স্মার্টফোন-ফেসবুক আসক্তি, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা এবং অনিদ্রাকে দায়ী করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, স্মার্টফোনে বারবার কল বা মেসেজ চেক করার প্রবণতা, ঘুম ভাঙামাত্রই ফোনটি খুঁজে দেখা, সাক্ষাতে কথা না বলে ভার্চুয়ালি কথাবার্তায় ঝোঁক থাকা, সব জায়গায় স্মার্টফোন নিয়ে যাওয়া, এমনকী স্মার্টফোন নিয়ে টয়লেটে যাওয়া, ফোনটিকে কখনো সুইচ অফ না করা, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই স্ক্রল করে যাওয়া, ফোনটি হারানোর ভয়ে থাকা এবং দৈনিক ৩ ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করা, মোবাইলের চার্জ, ব্যালেন্স বা ডেটা শেষ হয়ে গেলে অধিকমাত্রায় উদ্বিগ্ন হওয়া, ওয়াইফাই সিগন্যালের জন্য বারবার রিফ্রেশ করা এবং মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকলে অনলাইন পরিচিতি কমে যাওয়ার ভয় ইত্যাদি নোমোফোবিয়ার লক্ষণ।

এ বিষয়ে নিবন্ধটির গবেষক ফিরোজ-আল-মামুন বলেন, নোমোফোবিয়া বা মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকার ভয় একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রা এখন অনেকাংশে মোবাইল ফোন নির্ভর হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, নোমোফোবিয়া আমাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দিতে পারে এবং এটি বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। সমস্যাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে।

আরও পড়ুন: ফোনে বাংলা লেখার জনপ্রিয় ৫ অ্যাপ

দৈনিক স্মার্টফোন ব্যবহারে সময় কমানো এবং মাদকসেবন থেকে বিরত থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নোমোফোবিয়ার প্রকটতা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন এ গবেষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মনোবিজ্ঞানী শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জী বলেন, ‘স্মার্টফোন আসক্ত হওয়ার মধ্যদিয়েই এ আসক্তির উৎপত্তি। যাদের বাস্তব জগতে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা কম তাদের এসব আসক্তিতে পড়ার প্রবণতা বেশি। এ আসক্তির ফলে তাদের মানসিক চাপ বাড়ছে, রুটিন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাত জাগার ফলে তাদের স্বাস্থ্য সমস্যাও বেড়ে চলছে।

এ সমস্যা থেকে উত্তরণের বিষয়ে শুভাশীষ কুমার বলেন, ‘স্মার্টফোনের মতো ডিভাইসগুলোর ব্যবহারতো আমরা একেবারে বন্ধ করে দিতে পারি না। তবে যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়া যায়, বিশেষ করে একজন ছাত্র যখন পড়বে বা লাইব্রেরিতে থাকবে তখন এটাকে সুইচ অফ করা সম্ভব না হলেও সাইলেন্ট রাখা যায়। ঘুমানোর সময় বিছানাতে ফোনটি না রাখা ভালো।’

তিনি বলেন, যারা এরইমধ্যে স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছেন তারা ‘রেসপন্স-কস্ট’র মাধ্যমে এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। আর সেটা হলো এক ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করলে পরবর্তী দুই ঘণ্টা পড়বে বা এরকম কিছু করা যাতে অন্তত তাদের প্রধান যে কাজ সেটাতে তেমন ঘাটতি না হয়।

এসআর/এএসএম