লিচু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত পাবনার ঈশ্বরদীতে এবার লিচুর ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মাত্র ৪০ থেকে ৫০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছে। মুকুলশূন্য গাছের ডালগুলোর ডগায় গজিয়েছে কচি পাতা।
Advertisement
সাধারণত ফাল্গুনের শুরু থেকে উপজেলার প্রতিটি গ্রামে লিচুর মুকুলের মো মো সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উপজেলার ছোট-বড় সব রাস্তার দুই পাশেই চোখে পড়ে সোনালী মুকুল। কিন্তু চলতি মৌসুমে ঈশ্বরদীতে সেই চিরচেনা রূপ আর নেই। বৈরী আবহাওয়ায় লিচুর মুকুল অর্ধেকেরও কম এসেছে।
আরও পড়ুন- পাবনায় বট-পাকুড়ের বিয়ে, ছিল ভূরিভোজ
এরইমধ্যে লিচুর বাগান আগাম বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা লিচুর মুকুল দেখে বাগানের দাম হাঁকছেন।
Advertisement
লিচু ব্যবসায়ীরা বলছেন, মুকুল কম ও বৈরি আবহাওয়ার কারণে ফলন নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বাগান মালিকরা অন্যবারের তুলনায় এবার বাগানের দ্বিগুন দাম হাঁকছেন। বাগান বেচাকেনা শুরু হলেও এখনো তেমন সাঁড়া মেলেনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর ঈশ্বরদীতে ৩ হাজার ১শ’ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লিচু গাছে কাঙ্ক্ষিত মুকুল আসেনি। সাঠিকভাবে লিচু বাগানের পরিচর্যা করতে না জানা ও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার-কীটনাশকের ব্যবহার মুকুল কম আসার অন্যতম কারণ।
সরেজমিনে ঈশ্বরদীর লিচুগ্রাম হিসেবে পরিচিত মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, সাহাপুর ও বাঁশেরবাদা গ্রামে ঢুকেই চোখে পড়ে সারি সারি লিচুর বাগান। লিচু গাছে এবার মুকুলের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও লিচুচাষিরা বাগান পরিচর্যা ও গাছের চারপাশে বাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করছেন।
আরও পড়ুন- শেফালীর নকশিকাঁথা বিক্রি হচ্ছে ভারতের বাজারে
Advertisement
বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক আব্দুল জলিল ওরফে লিচু কিতাব জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এলাকার শতকরা ৫ ভাগ লিচুচাষি বাগানের পরিচর্যার সঠিক নিয়ম জানেন না। সার-কীটনাশকের ব্যবহারের পাশাপাশি কোন সময় লিচু গাছের পরিচর্যা করতে হয় এগুলো সম্পর্কেও তেমন কোনো ধারণা নেই। সেজন্য অনেক গাছে মুকুল আসে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে আরেকটি বিষয় আছে। এক বছর লিচুর ফলন ভালো হলে পরের বছর খারাপ হয়। গত বছর ফলন ভালো হয়েছিল। এ বছর তুলনামূলক গাছে মুকুল কম। ফলনও খুব বেশি ভালো হবে না। সঠিক সময়ে ও সঠিক নিয়মে পরিচর্যার কারণে আমার বাগানে মুকুল ভালো এসেছে। অন্যদের বাগানে শতকরা ৫০ ভাগের কম মুকুল এলেও আমার বাগানে ৯০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছে।
মানিকনগর গ্রামের লিচুচাষি মোস্তফা জামান নয়ন বলেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে লিচুগাছে মুকুল খুবই কম। বেশিরভাগ গাছেই মুকুলের পরিবর্তে কচি পাতা গজিয়েছে। আমার মতো সব লিচুচাষিই এবার লিচুর ফলন নিয়ে শঙ্কিত। বাগান পরিচর্যা করতে যে পরিমাণ সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের মজুরি লাগে, তা মিটিয়ে চাষিদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
সাহাপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক ও বাগানমালিক জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, আমার বাগানে প্রায় ৬০টি লিচুর গাছ রয়েছে। গতবারের তুলনায় অর্ধেকের কম গাছে মুকুল এসেছে। মুকুলের পরিমাণও খুবই কম। যে টাকা লিচুর পরিচর্যায় ব্যয় হয় এবার মনে হচ্ছে লিচু বিক্রি করে সেটা ওঠানো কষ্টকর হবে।
আরও পড়ুন- ঈশ্বরদীর পদ্মার চরে ফসলের সমারোহ
লিচু ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, এবার অর্ধেক গাছেও মুকুল আসেনি। এমনিতেই এবার ব্যবসা ভালো হবে না। আমরা যারা মুকুল দেখে বাগান কিনে থাকি এবার তারা বেশ বিপদে আছি। গত বছর যে বাগান ৩ লাখ টাকায় কিনেছিলাম এবারও সে বাগানে মুকুল মোটামুটি ভালো এসেছে। কিন্তু বাগান মালিক এবার দাম হাঁকছেন সাড়ে ৫ লাখ টাকা। এত দামে বাগান কিনে আমরা লাভ করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। এভাবেই প্রতিটি বাগানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বাগান মালিকরা।
সাহাপুর ইউনিয়নের উপ-কৃষি কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের ফলে গত কয়েক বছর ধরেই একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, এক বছর লিচুর ফলন ভালো হলে পরের বছর ফলন ভালো হয় না। তাই কৃষকরা ধরেই নিয়েছে এ বছর ফলন ভালো হবে না। তাদের ভাবনা অনুযায়ী এবার লিচুর মুকুলও কম এসেছে।
তবে কৃষকদের এ ভাবনার সঙ্গে কৃষি বিভাগ পুরোপুরি একমত নয়। বাগান পরিচর্যা ও লিচুচাষ সম্পর্কে কৃষকদের সঠিক ধারণা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। যারা সঠিক সময়ে বাগান পরিচর্যা করেছেন তাদের বাগানে লিচুর মুকুল পরিপূর্ণভাবে এসেছে বলেও জানান তিনি। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদীতে বেশ কয়েকজন লিচুচাষি রয়েছেন তাদের বাগানে প্রতি বছরই ভালো ফলন হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমি নিজে বেশ কয়েকজন চাষির বাগান পরিদর্শন করে দেখেছি তাদের গাছে ভরপুর মুকুল এসেছে। এটির কারণ হলো তারা লিচুচাষের সঠিক নিয়ম কানুন জানেন। সে অনুযায়ী পরিচর্যা করেছেন। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে মুকুল কম আসার একটি কারণতো রয়েছেই পাশাপাশি কৃষকদের লিচুচাষে অজ্ঞতা মুকুল কম আসার আরেকটি অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, যে পরিমাণে মুকুল এখনো গাছে গাছে রয়েছে সেগুলোর সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে চাষিরা লাভবান হবেন বলে আশা করছি।
এফএ/এমএস