প্রবাস

মাদ্রিদে মসজিদকেন্দ্রিক সেবা কার্যক্রমে প্রশংসিত বাংলাদেশিরা

কয়েক দশকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অগণিত মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। তারা এসব দেশে নির্মাণ করেছেন অসংখ্য সুন্দর সুন্দর মসজিদ। ইউরোপের অন্যতম পর্যটননির্ভর দেশ স্পেন। স্পেনেও রয়েছে অনেক মসজিদ ও ইসলামী মক্তব-কমপ্লেস।

Advertisement

এসব মসজিদের অন্যতম একটি মসজিদ হলো- রাজধানী মাদ্রিদে বাংলাদেশিদের ধারা পরিচালিত বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশ মসজিদ। এটি রাজধানী শহর মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম উপাসনালয়ের পাশাপাশি আশ্রয় এবং সেবা কেন্দ্র ও বটে।

গত করোনার সময় লকডাউন চলাকালীন অভাবগ্রস্তদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠন আসোসিয়েশন ভালিয়েন্তে বাংলার সহযোগিতায় ধারাবাহিক ত্রাণ এবং মসজিদকে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় বাংলাদেশিসহ মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অমুসলিমদের কাছে প্রশংসিত হয় মসজিদ পরিচালনা কমিটির এই কার্যক্রম।

যার ফলে কোভিড-১৯ দুর্যোগকালে মুসলিম কমিউনিটির এই সহায়তা নিয়ে জরুরি সেবা কার্যক্রম, দাফন কার্যক্রম, খাবার সরবরাহ, স্বাস্থ্যকর খাবারের ফ্যাসিলিটি, ওষুধ সরবরাহ ও পরামর্শ স্পেনের সর্বত্র প্রশংসিত হয়। পরে স্পেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মসজিদ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তারা কোভিড-১৯ কঠিন সময়ে কঠোর পরিশ্রমের জন্য সবাই অভিনন্দন জানান।

Advertisement

এরই মধ্যে বাংলাদেশিদের দ্বারা পর্যটন নগরী বার্সেলোনা এবং মাদ্রিদের নিকটবর্তী স্থানে মসজিদ- মক্তন নির্মাণ করলে ও স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং জাতীয় থিয়েটার, রানী সূফিয়া জাদুঘর, জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এছাড়াও পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ বা প্রাণবন্ত মারকাডো দে সান ফার্নান্দোর মতো আধুনিক শিল্পের মাস্টারপিসের জন্য বিখ্যাত চিজ, বই এবং ক্রাফ্ট বিয়ার নিয়ে সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময়, এই এলাকা বাঙলি পারা নামে খ্যাত এই লাভাপিয়েস এলাকা ৯০ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশিদের দখলে। এ যেন মাদ্রিদের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ।

এছাড়া চমৎকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক এখানে রয়েছে। রাজধানী প্রবেশদ্বার খ্যাত (পুয়ের্তা দে আতছা) মেট্রোরেল, বাস এবং শহরতলীর ট্রেন উভয়ই, যা সমগ্র রাজধানীর যাতায়াতের পাশাপাশি পুরো ইউরোপের যোগাযোগের অনন্য সংযোগস্থল। মাদ্রিদ মিউনিসিপ্যাল সিটি, স্কুল কলেজ এবং ২টি বিশাল পার্ক শিশু-কিশোর এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ স্থান।

৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। একটি গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয় গ্রানাডার হাজার হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ। নিরাপত্তার জন্য মুসলমানরা আশ্রয় নেয় মসজিদে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকরা মসজিদে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় মুসলমানরা। চিরতরে হারিয়ে যায় তাদের আটশত বছর স্পেন শাসনের গৌরবময় স্মৃতি।

স্পেনে মুসলিম শাসনামলকে প্রায়ই জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ বলা হয়। যেখানে গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও হাম্মামখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর সেই সঙ্গে বিকাশ লাভ করেছিল সাহিত্য, কবিতা এবং স্থাপত্যকলা। মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ই এতে অবদান রেখেছিল ব্যাপকভাবে।

Advertisement

দাওয়াত ও তাবলীগের কল্যাণে বর্তমানে স্পেনের মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ক্রমেই আশ্রয় নিচ্ছে। দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে স্পেনের সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার ৪.৫ ভাগ মুসলিম। ২০২৭ সালে স্পেনে মুসলিম জনসংখ্যা ৭ লাখে দাঁড়াবে, যা হবে জনসংখ্যার প্রায় ১৪ ভাগ। মুসলমানদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে সেখানে নির্মিত হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসা। সরকার থেকেও পাচ্ছে সুযোগ-সুবিধা আর নিরাপত্তা।

স্পেনে বাংলাদেশিদের আগমন ১৯৯৯/২০০ থেকে। তবে ২০০০ সালে আসা শুরু করলে ৫ বছরের মাতায় ২০০৬ সালে বাংলাদেশি সবার প্রচেষ্টায় মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রা শুরু বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশ মসজিদ নামে। দীর্ঘ ১৬ যাবত বাংলাদেশি নমুসলিমদের পাশাপাশি আফ্রিকা, সেনেগাল, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোর মতো দেশগুলোর মুসলমানরা আর্থিক অনুদান এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। অবশেষে বাংলাদেশি অধ্যুষিত লাভাপিয়েছ ৪৪০ মিটার আয়তনের বর্তমান ভবন মসজিদটি এক মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে গত বছর জুলাই মাসে ক্রয় করা হয়।

বর্তমানে মাদ্রিদের বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশ মসজিদ অনেকটা মুসলমানদের ধর্মীয় সামাজিক কাজে জড়িত। বিবাহ, তালাক, আইনি পরামর্শ, সারাদেশের জুমা ও ঈদের নামাজ পরিচালনা, হজে লোক পাঠানো, হালাল উপায়ে পশু জবাইয়ের প্রতি নজরদারি, মৃতদের দাফন, এতিম শিশু ও অসহায় পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়াসহ এ ধরনের আরও অনেক সেবামূলক কাজ করে এই মসজিদ।

মসজিদের উদ্যোগে এখানে স্থাপিত হয়েছে একটি বিশাল লাইব্রেরি। সেইসঙ্গে ইসলামকে অমুসলিমদের সামনে তুলে ধরার জন্য মসজিদের অডিটোরিয়ামে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এছাড়া ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের ভুল ধারণা দূর করতে এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সেমিনার।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগী ও ইসলামের প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নে এবং ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও মূল্যবোধসহ ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী প্রচার করার লক্ষ্যেই মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের জন্য নয়, ইসলাম ধর্মের সুমহান আদর্শ সমাজে ছড়িয়ে দিতে তিন বছর মেয়াদি এই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব পেয়েছেন বর্তমান সভাপতি কমিউনিটির ঐক্যের প্রতীক খ্যাত খোরশেদ আলম মজুমদার।

সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেনের সদ্য সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশি অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ঢাকা ফ্রুটাস এর কর্ণধার আলামিন মিয়া। অঞ্চলভিত্তিক হরে ১২ সদস্যের কার্যকরী পরিষদসহ ২১ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি। নবগঠিত কমিটির উদ্যোগে মসজিদের যাবতীয় সংস্কার-উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে মাদ্রিদে বাংলাদেশিদের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এই প্রত্যাশ কমিউনিটি নেতাদের।

এমআরএম/জিকেএস