দেশজুড়ে

বাধা পেরিয়ে স্বর্ণলতার এগিয়ে যাওয়ার গল্প

কিশোরী বয়সে সাত পাকে বাঁধাপড়া স্বর্ণলতা রায় শত বাধা ডিঙিয়ে এখন সফল উদ্যোক্তা। মাত্র দুইজন নারী কর্মী দিয়ে শুরু করা স্বর্ণলতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখন চাকরি করছেন ৩০ জন। এ পর্যন্ত তিনি সহস্রাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করেছেন। নিজ হাতে গড়া সংগঠন সিলেট উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এবং উইমেন্স ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের সত্ত্বাধিকারী তিনি।

Advertisement

স্বর্ণলতা রায় শুধু একজন সফল উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ী নেতা নয়, তিনি একজন সফল মাও। তার এক মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে মেয়ে চিকিৎসক হিসেবে সুইডেনে চাকরি করছেন। বড় ছেলে প্রকৌশলী আর ছোট ছেলে নগরের একটি নামকরা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় স্বর্ণলতা রায় জানান, একজন সৎ সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর পরপরই কিশোরী বয়সে ১৯৮৮ সালে বিয়ে হয়। স্বামী সিলেট নগরের জামতলা এলাকার বাসিন্দা শেখর কুমার দাশ বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। স্বামীর সংসারে এসে ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হতে শুরু করে তার কিশোরী বয়সের স্বপ্নগুলো। কিন্তু দমে যাননি তিনি। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। একসময় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটি থেকে শতভাগ স্কলারশিপে লিডারশিপের ওপর ফেলোশিপ করেন তিনি।

স্বর্ণলতা রায় বলেন, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ১৯৯৩ সালে রূপালী ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করি। তখন শুরু হয় আরেক লড়াই। ‘ঘরের বউ কেন বাইরে যাবে?’ পাড়া-প্রতিবেশীরা এমন প্রশ্ন তোলেন। এমনকী শ্বশুরবাড়ির কেউ কেউ চাকরি নিয়ে বাঁকা কথা বলতে লাগলেন। নানাজনের নানা কথা শুনে একপর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে চার বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিই। এরপর পুরোদস্তুর গৃহিণীর জীবন শুরু। কিছুদিন পর দুবাইয়ে মামার কাছে বেড়াতে যাই। সেখানেই একজনের সঙ্গে কথা বলে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

Advertisement

তিনি বলেন, দুবাই থেকে ফিরে নতুন নেশা পেয়ে বসে। পরিবারের সদস্যরা প্রথমে মত না দিলেও আমার চাপাচাপিতে তারা আর বাধা দেননি। তবে আমার স্বামী শুরুতেই বলে দেন, ব্যবসা অনেক কঠিন। মেয়েদের পক্ষে তা আরও কঠিন! এরপর থেকে জিদ চেপে বসে। তাই ব্যবসায় সফল হয়ে স্বামীকে দেখিয়ে দেওয়ার পণ করি। এরপর বিউটিফিকেশনের ওপর ডিপ্লোমা কোর্স করি। ২০০৪ সালে শুরু পার্লার ব্যবসা। প্রথমদিকে দুইজন কর্মী দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়তে থাকে। এর দুই বছর পর চালু করি আরেকটি পার্লার। সিলেট নগরের মীরের ময়দান ও লামাবাজারে প্রতিষ্ঠানটির দুটি শাখা আছে। বর্তমানে এই দুই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কর্মী আছেন ৩০ জন।

স্বর্ণলতা জানান, তার উইমেন্স ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে কাজ করা নারীদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসার জন্যই তার প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের তরুণীদের চাকরি দিয়েছেন। তার পার্লারের দুই শাখাতেই ভালো ব্যবসা হয়। চুল কাটা, চুল বাঁধায়, ত্বকের পরিচর্যা, মেকআপ, বউ সাজসহ নারী ও শিশুদের সৌন্দর্যবিকাশে সব ধরনের সেবা দেওয়া হয়।

স্বর্ণলতা রায় বলেন, একে তো পরিবারের সমর্থন ছিল না, এর মধ্যে আবার আমার ছিল পার্লার ব্যবসা। নারী হওয়ায় শুরুতে অনেকে আমাকে দোকান ভাড়া দিতে চাইতেন না। সামাজিক বাধাও ছিল। পার্লারে নারীদের আসা-যাওয়ার কারণে অনেকে বিষয়টি ভালোভাবে নিতেন না। এজন্য আমার বিরুদ্ধে নানা কুৎসা ছড়ানো হয়, তা সহ্য করতে হয়েছে নীরবে। আমার কর্মীদেরও বাসা ভাড়া পেতে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।

এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে নারী হওয়ায় একটা সময় ব্যাংক ঋণও পাইনি। পরে স্বামীর নামে ঋণ নিয়ে আমাকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে হয়েছে। এত এত বাধা পেরিয়ে এখন আমার প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। এখন আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যবসাবান্ধব নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা এখন ঋণ দিতে আমার কাছে আসেন। সমাজেও কেউ আর এখন বাঁকা চোখে দেখে না। সমাজ এখন বদলে গেছে।

Advertisement

স্বর্ণলতা জানান, নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিশোরী ও নারীদের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন এই উদ্যোক্তা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অনুপ্রেরণা দিয়ে সিলেটে কয়েকশ নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন।

২০১৫ সালে ‘সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নিজের সংগঠন ও চেম্বারের মাধ্যমে স্বর্ণলতা সিলেটের সহস্রাধিক নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেন। ২০১০ সালে বর্ষসেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার উইমেন্স ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড জাতীয় এসএমই পুরস্কার পেয়েছে। ২০১৫ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এনপিও পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ২০২০ সালে স্বর্ণলতা রায় পেয়েছেন সিলেট বিভাগে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক। ২০২২ সালে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডের জুরি বোর্ডের অনারারি সদস্য হিসেবে তিনি বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে ২০১৫ ও ২০১৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এবং ভারত সফরে যান। ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে স্বর্ণলতা রায় অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডনে ব্যবসায়ী সম্মেলনে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সফল স্বর্ণলতা রায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিলেটে মেয়েদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চান। তিনি বলেন, আমার অবস্থান থেকে সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে সহযোগিতায় নারী সমাজকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আর এজন্য সিলেটের মেয়েরা কারিগরি শিক্ষায় যাতে দক্ষতা অর্জন করে উদ্যোক্তা হতে পারেন এটা আমি মনেপ্রাণে চাই।

এমআরআর/এএসএম