গত বছরের ২৬ জুন রাজধানীর বাড্ডায় সাতারকুল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজনীন আক্তার (ছদ্মনাম) নোটবই ফটোকপি করার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। এরপর আর বাসায় ফেরেননি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাকে না পেয়ে কিশোরীর মা বাড্ডা থানায় প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে কিশোরীর সহপাঠী জুবায়ের আহমেদকে (ছদ্মনাম) আসামি করে একটি অপহরণ মামলা করা হয়।
Advertisement
মেয়ে হারানোর ঘটনা প্রসঙ্গে কিশোরীর মা জাগো নিউজকে বলেন, তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল তা জানতাম না। ঘটনার একদিন পর মেয়েকে পেয়েছি। পরে দুই পরিবারের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা হয়। মামলাটাও উঠিয়ে নিয়েছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আরও পড়ুন: পালিয়ে বিয়ে, অপহরণ মামলা তুলে নিতে তরুণীর আত্মহত্যার হুমকি
একই বছর বাড্ডার আলাতুননেছা স্কুলের ১০ শ্রেণি পড়ুয়া আসমা খাতুন (ছদ্মনাম) নামের আরেক কিশোরী একই স্কুলের আরেক সহপাঠীর সঙ্গে পালিয়ে যায়। এতে তার বাবা বাড্ডা থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে মেয়ের বাবা বলেন, ‘আসলে আমার মেয়েকে পাচ্ছিলাম না। আমরা সন্দেহমূলকভাবে যেই ছেলের নামে মামলা দিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। এখন মামলা আমরা উঠিয়ে নেব। উকিলের সঙ্গেও কথা বলেছি।’ঘটনার দুই মাস পর মেয়েকে ফিরে পান তিনি।
Advertisement
দুজনের সম্পর্কের কথা জানার পর দুই পক্ষ বিষয়টি মীমাংসা করে। ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই দুই পরিবারে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ‘পালিয়ে গেল’ ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী, বাবা দিলেন অপহরণ মামলা
রাজধানীতে গত বছর প্রেমের সম্পর্কের জেরে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অপহরণের মামলা হয়েছে। অপহরণের মামলা করে সম্পর্ক মেনে নিয়ে সেই মামলা আবার তুলেও নিয়েছে অভিভাবকরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে ৪৪১ নারী ও শিশুকে অপহরণ করা হয়। নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনায় অধিকাংশই প্রেমঘটিত এবং তারা ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী। এর মধ্যে যারা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী তাদের ক্ষেত্রে শিশু অপহরণ মামলা হয়ে থাকে। ফলে এসব ঘটনায় অভিভাবকরা অপহরণ মামলা করে থাকেন। এছাড়া গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরে নারী ও শিশু অপহরণের দুই হাজার ৩৬৫ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নারী অপহরণের ঘটনায় মামলা এক হাজার ৫১০টি ও শিশু অপহরণ মামলা ৮৫৫টি।
ডিএমপির বেশ কয়েকটি থানার অপহরণ মামলা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অপহরণের শিকার হন নারী ও শিশু। আবার প্রেমের সম্পর্কের জেরে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অপহরণ মামলা করে তা আবার তুলেও নিয়েছে। গত বছর বাড্ডা থানায় প্রেমঘটিত ৪টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এর দুটি প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অপহরণ করা হয়। বাকি দুটি প্রেমের সম্পর্কের কারণে পালিয়ে গেছে। এমন অপহরণ মামলার ঘটনা শুধু বাড্ডা থানায় নয়, অন্য থানায়ও আছে।
Advertisement
আরও পড়ুন: মেয়েকে লুকিয়ে রেখে অপহরণ মামলা: ১২ বছর পর উদ্ধার
এদিকে গত বছর শুধু পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অপহরণ মামলা নয়, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার সাতারকুল রোডের জান গার্মেন্টস-২ তে অপারেটর হিসেবে কাজ করেন বীণা রানী মণ্ডল (ছদ্মনাম)। একই গার্মেন্টে চাকরি করতেন রাফিজুল মোল্লা নামের এক তরুণ। ঢাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকলেও গার্মেন্ট থেকে বিভিন্ন সময় আসা যাওয়ার পথে বীণা রানীকে বিভিন্ন ধরনের কু-প্রস্তাব দিতেন রাফিজুল। এসব প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রায়ই তিনি তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতেন। বিষয়টি বীণা রানী তার মাকে জানালে প্রথমে রাফিজুলকে এসব করতে নিষেধ করেন, পরে তার স্ত্রীকেও জানান। এতে তার স্ত্রী অন্য মানুষ দিয়ে রাফিজুলকে মারধর করেন। এরপর স্ত্রীকে ঢাকায় রেখেই তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান।
এ ঘটনার কয়েকদিন পর তিনি ঢাকায় আসেন। গত বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে বীণা রানী জন গার্মেন্ট থেকে খাবার খেতে বাসায় আসার পথে তাকে জোর করে অপহরণ করেন রাফিজুল। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন অপহৃত কিশোরীর মা। ঘটনার পাঁচদিন পর খুলনা থেকে বীণা রানী মণ্ডলকে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর অপহরণ মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাফিজুলকে। পরে তিনি জামিনও পান।
আরও পড়ুন: মায়ের ‘অপহরণ’ সাজানো, নিয়মিত টাকা পাঠাতেন মরিয়ম
ঘটনা ও মামলার বিচার নিয়ে বীণা রানীর মা জাগো নিউজকে বলেন, মেয়েকে অপহরণের আগ থেকেই উত্ত্যক্ত করতো। প্রেমের প্রস্তাব দিতো, মেয়ে বলেছে সম্পর্ক করা যাবে না। এরপর জোর করে আমার মেয়েকে অপহরণ করে খুলনায় নিয়ে যায়। পাঁচদিন পর মেয়েকে পায় পুলিশ। ছেলেকেও গ্রেফতার করে। মামলার বিচার চলছে।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর মহাখালী থেকে অপহরণের শিকার হন মহাখালীর মাসতুরাত মাদরাসায় পড়ালেখা করা ফারিন রহমান (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরী। এ ঘটনায় ফাস্ট ফুড দোকানের কর্মচারী মো. শওকত নামের এক তরুণের বিরুদ্ধে বনানী থানায় একটি অপহরণ মামলা করে কিশোরীর বাবা।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, মেয়েকে রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে অপহরণ করে প্রথমে চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে নোয়াখালীতে নিয়ে যায়। ছেলের পরিবারকে চাপ দিলে ঘটনার একদিন পর মেয়েকে নিয়ে আসে। মামলাটি এখনো চলছে; তবে অপহরণকারী পলাতক।
গত ১ জুন মেরুল বাড্ডা থেকে মোসা. ফারিয়া আক্তার (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরীকে মো. ফরহাদ হোসেন (২২) নামের এক তরুণ অপহরণ করেন। বাড্ডা থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন কিশোরীর বাবা। এ ঘটনায় আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: মাহবুব আমাকে অপহরণ করেনি, আমরা বিয়ে করেছি
থানাটিতে প্রেমের কারণে অপহরণ হওয়া মামলার বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়েরা অপ্রাপ্ত বয়সে অনেক সময় প্রেমের সম্পর্কের কারণে পালিয়ে যায়। অভিভাবকরাও অপহরণ মামলা করেন। এরপর যখন ফিরে আসে তখন দুই পরিবার যদি মীমাংসায় চলে আসে তখন মামলা তুলে নেয়। আর যখন অপহরণের ঘটনাই ঘটে তখন আমরা তদন্ত করে মামলার চার্জশিট দেই।’
আইনের দ্রুত প্রয়োগ ঘটলে এ ধরনের ঘটনা কমে যাবে। অপহরণ মামলাগুলো সহজভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। পুলিশের আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের সদস্য ড. তানিয়া রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দিনের পর দিন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছি যে আমাদের সহ্য ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তা না হলে ইচ্ছে হলেই খুন, অপহরণ আমরা করছি। অপহরণ মামলাগুলো সহজভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। পুলিশের আরও গুরুত্ব দিয়েই দেখা উচিত। কারণ যথাযথভাবে দ্রুত প্রয়োগ করলে আইনটা ভঙ্গ করতে গেলে অন্যরা আরও সতর্ক হবে। তখন এ ধরনের ঘটনাও কমে যাবে।
আরএসএম/এসএইচএস/এএসএম