"একমাত্র প্রকৃত কারাগার হল ভয় এবং একমাত্র প্রকৃত স্বাধীনতা হল ভয় থেকে মুক্তি।" ভয় কে জয় করতে পেরেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে এক ক্ষণজন্মা সূর্য সন্তানের জন্ম হয়েছিল। যিনি বাঙালি জাতির মুক্তি প্রত্যাশী হয়ে সত্যান্বেষী হয়ে লড়েছিলেন। অতি অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হতে পেরেছিলেন। আমরা একজন শেখ মুজিবের কথা বলছি।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু, যখন ৭ মার্চ ১৯৭১-এ ভাষণ রাখতে চলেছেন, পুরো বাঙালি জাতি তাঁর অপেক্ষায় ছিল। কী বলবেন, কি করবেন, দেশবাসী কি করবে- এমন নানা পর্যায়ের প্রশ্ন আদলে দেশাত্মবোধের উচ্ছ্বাসে বিভোর মানুষগুলো অবশেষে দেখতে পেল, শুনতে পেল। দরাজ কণ্ঠের সাথে আবেগ, দ্রোহের মিশেলে একটি কবিতার পাঠ যেন! বাস্তবতায়, এই গ্রহের রাজনৈতিক পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ভাষণ কিনা- তা নিয়ে গবেষণা চলছে ও চলবে।
বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, আমি যদি তোমাদের হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। এই 'হুকুম' শব্দের বৈজ্ঞানিক ব্যাখার অন্বেষণে থাকতে পারলে বোঝা যায় যে, ভয় কে জয় করে তিনি প্রকৃত স্বাধীনতা সবার আগে এনেছিলেন তাঁর দেহ ও মনে। তিনি নিজেকেই আগে স্বাধীন করেছিলেন।
অর্থাৎ বলতে চাইছি, কোন এক কালো রাত্রি করে একজন বঙ্গবন্ধুকে ওই মার্চ মাসেই তুলে নিয়ে যাওয়া, কারাগারে বন্দী করা- এসব উপলক্ষ ফিকে হয়ে পড়ে, যখন তিনি ৭ মার্চে ভয় নামক প্রকৃত কারাগারের বেষ্টনি ডিঙিয়ে বলতে পেরেছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।
Advertisement
৭ মার্চের ভাষণ, এই পৃথিবীর কোন ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিভাত দক্ষতার বিকাশের উদাহরণ। যেখানে নেতার ধারাভাষ্যে একটি জাতির বঞ্চিত থাকার ঐতিহাসিকতা তুলেধরত শাসন, শোষণ, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সামাজিক নিরাপত্তার হিসাব কষে জনশ্রেণি মুক্তি প্রত্যাশী হয়ে একটি স্বাধীন সড়কের গন্তব্য খুঁজে নিক বা নিতে হবে, তা স্পষ্ট হয়েছিল।
মানবজীবন, অভিভাবকত্বের পরশ প্রত্যাশী। যে অভিলাষে প্রতিটি সত্তা জ্যেষ্ঠ কোন আত্মায় মন সঁপে দেয়। সে কারণেই পারিবারিক সম্পর্কগুলো শুধুই সামাজিক নয়, আধ্যাত্মিকতার স্পর্শে তা অধিকতর শক্তিশালী। একটি মন নানা অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পরিবারের মধ্যে কাউকে আদর্শ হিসাবে পেতে চায়। একইভাবে গোষ্ঠিগত চিন্তার উদ্রেক জানান দেয়, কোন একজন সমাজপতিকে আদর্শ হিসাবে ধরে নিয়ে চলার পথকে মসৃণ কর।
মানচিত্র ভিত্তিক চিন্তায় স্বাধীন একটি দেশের জন্য মন তাই নেতাকে খুঁজে। নেতার মেধা, সততা, নৈতিকতা, চরিত্র, দেশপ্রেম, দূরদৃষ্টি, সুবক্তা হওয়ার সকল গুন কারোর মাঝে পরিলক্ষিত হলে, তিনি অতি অবশ্যই নেতৃত্বগুনে মহান নেতা। কিন্তু, এক সত্তায় কি এত গুন থাকে?
তবুও, মানুষ আশাবাদি হয়ে কয়েকটি গুন থাকলেও নেতা বেছে নিয়ে তেমন নেতার রাজনৈতিক দলকে ভালোবাসতে শুরু করে। আবার জনস্বার্থের রাজনৈতিক দল দ্বারাও কোনো নেতা জনশ্রেণির মনের কোণে জায়গা নিতেই পারে। ঘুরেফিরে গুনাবলি পরখকরত এক পর্যায়ের দর্শক বনে মানুষ ব্যক্তি বা কোন সংগঠনকে 'প্রাণ' হিসাবে ঘোষণা করে।
Advertisement
মৌলিক যৌগিক পর্যায়ের অযুত গুনধারী হয়ে একজন বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের আত্মার টান এমন পর্যায়ে ছিল যে, তিনি যা বলতেন, তা মানুষ গ্রহণ করতেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের আকাশতুল্য উচ্চতা, যা এই দেশে তাঁকে ছাপিয়ে যেয়ে জোর করে বড় হওয়া যাবে না। মন তাই ওই দীর্ঘকায় মানুষটির কাছে বন্ধক রেখেছি। মানুষও রেখেছে আজ অব্দি। তাঁর রক্তের কেহ না হয়েও মানুষ বলতে পারে, আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু, আমাদের আদরের নাম! এখানেই তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিভাবক।
অভিভাবক হতে পারাটা কঠিন। উপরন্ত, যদি দৈহিক অস্তিত্ব বিরাজ না করে। গ্রহান্তরীত সত্তাকে সর্বদা মনে ধরে রাখা সহজ নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বেলায়? তিনিই কবি ছিলেন। রাজনীতির আসল কবি। তিনিই দার্শনিক ছিলেন। তিনিই সত্যিকারের নেতা ছিলেন। যখন কথা বলতেন, মানুষ চুপ করে শ্রোতা হয়ে যেত। আর এখন? আমাদেরকে মানুষের সামনে যেয়ে সমাবেশে বলতে হয়, এই আপনারা থামেন, আমার কথা শোনেন- ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ যা বিশ্বাস করি, তা ধারণ করে বলতে না পারলে মানুষ কথা শুনতে চায় না।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পূর্ণতা পায় অনেকাংশে ৭ মার্চের ভাষণে। অসাধারণ পর্যায়ের নেতৃত্বের সকল শর্ত পূরণ করে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতে পেরেছেন। ৭ মার্চ? ৭ মার্চ এর ভাষণ নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্বও প্রদর্শন করে- আজ আমি বলছি, পরের প্রজন্মও বলুক। আর বঙ্গবন্ধুকেই অনাগত সন্তানেরাও প্রিয় অভিভাবক হিসাবে বেছে মন দিয়ে দিক, এমন প্রত্যাশায় আমিও একদিন গ্রহান্তরীত হতে চাই। যেখানে বেহেসতে তাঁকে দেখতে চাই, পেতে চাই।
লেখক: সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এমএস