একসময় পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা। অর্থকরী ফসল সোনালী আঁশকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল এ নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু সেই প্রাচ্যের ড্যান্ডিতে এখন আর পাটের দেখা মিলছে না। শহরের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেঁষে বিশ্বের সব থেকে উন্নতমানের পাটের চাষ হলেও তা যেন এখন কল্পনাতীত।
Advertisement
এসব জায়গায় এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। ফলে আবাদি জমিগুলো পরিণত হয়েছে অনাবাদিতে। পাট চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনেক ঝুট কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পাট ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী পাটের ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে তাদেরও ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর এভাবেই কালের বিবর্তনে নারায়ণগঞ্জ হারাচ্ছে তার সোনালি অতীত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারায়ণগঞ্জে পাটের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯৮৯ একর। পাট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩২৫ বেল। ২০২০-২১ অর্থবছরে নারায়ণগঞ্জে পাটের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৮০৬ একর। পাট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৮ বেল। ২০২১-২২ অর্থবছরে নারায়ণগঞ্জে পাটের আবাদি জমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৭৬৯ একরে। পাট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৪৭ বেল।
Advertisement
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও নারায়ণগঞ্জে পাটের আবাদি জমির চাষ এবং উৎপাদনের পরিমাণও অনেক কমে এসেছে। এ অর্থবছরে নারায়ণগঞ্জে পাটের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৬৭৮ একর। পাট উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৬৪৭ বেল।
জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের এক সুপারিশে বলা হয়েছে, বর্তমানে পাট চাষ পাট আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমদানিকৃত পাট বীজ নিম্নমানের হওয়ায় উৎকৃষ্টমানের পাট চাষ ব্যাহত হচ্ছে। তাই দেশে পূর্বের ন্যায় পাট বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে সঠিক নির্দেশনা থাকা আবশ্যক। অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ন্যায় পাটখাতে সাবসিডি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক আইন এবং পাট আইন বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। কাঁচাপাট রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে বেলিং চার্জ সহনীয় পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন।
কুমুদিনী এলাকার একটি পাটের গোডাউনের সরদার নূর হোসেন বলেন, কৃষকরা পাটের সঠিক মূল্য পায় না। লোকসানসহ নানা কারণেই পাটের চাষ অনেক কমে গেছে। আগে আমাদের এখানে দিন রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ হতো। কিন্তু এখন কোনো কাজই হয় না। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে।
Advertisement
নারায়ণগঞ্জ পাট শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পাট ব্যবসায়ী মো. শুক্কর আলী বলেন, সারাদেশে যে পাট হতো তার ৮০ শতাংশ নারায়ণগঞ্জের ছিল। পাট দিয়েই নারায়ণগঞ্জ প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা বিলুপ্তির পথে। পাট ব্যবসায়ীরা পাটের সঠিক দাম পাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে লোন পাচ্ছে না। পাট কোম্পানিগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। যদি সরকার আমাদের প্রতি সুনজর দেয়, তাহলেই পাটের সুদিন ফিরে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আগে আমাদের এখানে ৪-৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। বর্তমানে ১০০ শ্রমিকও হবে না। সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষক যদি পাটের সঠিক মূল্য পেতো তাহলে চাষে উৎসাহী হতো। এর জন্য দায়ী আমাদের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
নারায়ণগঞ্জ পাট অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সব জায়গাতেই পাটের চাষ কমে এসেছে। ফলে তুলনামূলক নারায়ণগঞ্জে পাটের অবস্থান আগের মতো নেই। এরপরও পাটের জন্য নারায়ণগঞ্জ বিখ্যাত। সারাদেশের মধ্যে দুই জায়গা থেকে পাটের রপ্তানি হয়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জও আছে।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ শিল্প এলাকা। ফলে কৃষি আবাদ কমে গেছে। একই সঙ্গে পাট চাষও কমে গেছে।
নারায়ণগঞ্জ পাট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে তুলনামূলক পাটের অবস্থান ভালো। নারায়ণগঞ্জ এখনো এক নম্বরে আছে। দেশের মধ্যে দুটি জায়গা থেকে পাটের রপ্তানি হয়। একটি হলো খুলনা এবং আরেকটি হলো নারায়ণগঞ্জ। এখানে আদমজীসহ অনেকগুলো ঝুটমিল হয়েছিল। এ সময় ভারতে ১৭টি ঝুটমিল তৈরি হয়। পরবর্তীতে আমাদের দেশে বন্ধ হতে থাকে আর ভারতে চালু হয়।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে আগের তুলনায় পাটের চাষ কমে গেছে। দেশে ১৯টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটজাত মোড়ক আছে। এসব পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। যদি এটা করা যায় তাহলে পাটের যে অবস্থান ছিল তা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। আমরা জাতীয় সম্পদকে ধরে রাখতে পারছি না। এজন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ঝুট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ সভাপতি আরজু রহমান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে পাটের বাজারমূল্য কম নিম্নগতি। এর কারণ কাঁচাপাট রপ্তানি কমে যাওয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে এগুলোর রপ্তানি কমে গেছে। যার কারণে স্থানীয় বাজারে পাটের দাম যেখানে ৩ হাজার টাকা ছিল সেখানে আড়াইহাজার টাকায় নেমেছে। নিম্নমানের পাট যেখানে আড়াইহাজার টাকা ছিল তা এখন নেমেছে ২ হাজার ১০০ টাকায়।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ এখন প্রাচ্যের ড্যান্ডি নেই। নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায়ী কমে গেছে, প্রেস হাউজ কমে গেছে। কাঁচাপাট রপ্তানি কমেছে। নারায়ণগঞ্জে আদমজী ঝুটমিলসহ অনেক বড় বড় ঝুটমিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অল্প সংখ্যক কিছু ব্যবসায়ী আছে। বিশ্বে কাঁচাপাটের চাহিদা কমে গেছে। বাংলাদেশে সুতা উৎপাদন কারখানা বেশি।
এসজে/জেআইএম