প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলো বাংলাদেশে, তা অবিশ্বাস্য। নতুন করে ফলাফল ঘোষণার চারদিন পরও বিষয়টি আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আমার ধারণা কখনোই পারবো না। যখনই এই অন্যায়টির কথা মনে হবে আমার, এক অক্ষম ক্রোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে।
Advertisement
যতক্ষণ দায়ীদের শাস্তি না হবে, ততক্ষণ নিজেকেই অপরাধী মনে হবে। মনে হবে আমরা যথাযথ প্রতিবাদ করতে পারিনি বলেই অপরাধীরা পার পেয়ে গেছে। আর শিশুদের মনে সারাজীবনের জন্য এক হীনমন্যতার চিরস্থায়ী দাগ দিয়ে দিলাম আমরা, মানে বড়রাই। অযথা বড়দের দায়িত্ব ছোটদের আগলে রাখা। আর আমরা করলাম উল্টো কাজ।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ঘটা করে ২০২২ সালের প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ফলাফল ঘোষণার পর, আত্মীয়-স্বজনকে জানানো, মিষ্টি খাওয়ানো, ফেসবুকে সন্তানের সাফল্যের খবর, তাতে অভিনন্দনের জোয়ার- সবই হলো। কিন্তু হরিষে বিষাদ নেমে এলো ছয় ঘণ্টা পরই। রাতে জানালো হলো, ঘোষিত ফলাফল স্থগিত।
পরদিন মানে বুধবার আবার ফলাফল ঘোষণা করা হবে। দায় দেওয়া হলো কারিগরি ত্রুটিকে। শিশুদের একটি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর সেটি স্থগিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ শিশুদের আনন্দ দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, তাদের আনন্দ স্থগিত করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। অনেকেই ফলাফল স্থগিত ঘোষণার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। শিশু মনের ওপর এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। ফলাফল স্থগিত ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতিআরা নাসরিন ফেসবুকে লিখেছিলেন, বোধহয় পরেরবার বৃত্তি পরীক্ষায় ট্রানস্লেশন থাকবে, ‘মিষ্টি খাইবার পর ফল বদলাইয়া গেল।’
Advertisement
আমি আপার স্ট্যাটাসটি ফান হিসেবেই নিয়েছিলাম। আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা একটা সভ্য সমাজে ঘটতে পারে। আমার ধারণা ছিল, যারা প্রথম ফলাফলে বৃত্তি পেয়েছে, তারা তো থাকবেই, হয়তো নতুন আরও কিছু যুক্ত হবে। কমনসেন্স কিন্তু তাই বলে। তবে পরীক্ষায় অংশই নেয়নি এমন অনেকেই প্রথম ফলাফলে বৃত্তি পেয়েছিল। এইটুকু ভুল হয়তো শুধরে নেওয়া হবে। তবু যারা বৃত্তি পেয়েছে, তাদের একদিন অনিশ্চয়তায় রাখা নিয়েই আমার আপত্তি ছিল। কিন্তু বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় নতুন ফলাফল ঘোষণার নামে যা করা হলো, তা ভয়ঙ্কর অপরাধ। নতুন ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে আসলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের অদক্ষতা, অক্ষমতা, অসংবেদনশীলতা, অপরিণামদর্শীতার চূড়ান্ত প্রমাণ জাতির সামনে তুলে ধরলো।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফলে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা এখনও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। নতুন ফলাফল ঘোষণার আগে আমি লিখেছিলাম, যারা বৃত্তি পেয়েছে, তাদের একজনও যেন ভুলেও বাদ না পড়ে। কেউ বাদ পড়তে পারে, এটা ভাবিইনি। তবু ভুলেও যাতে বাদ না পড়ে, সেটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, শিশুদের ফলাফল লন্ডভন্ড করে দিয়েও তারা নির্বিকার। কতটা পরিবর্তন এসেছে, মন্ত্রণালয় সেটা না জানালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ফলাফল আসলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মঙ্গলবার যারা বৃত্তি পেয়েছিলেন, তাদের অনেকেই বাদ পড়েছেন, অনেকে নতুন যুক্ত হয়েছেন, অনেকে ট্যালেন্টপুল থেকে সাধারণ কোটায় নেমে গেছেন, অনেকের আবার সাধারণ কোটা থেকে ট্যালেন্টপুলে প্রমোশন পেয়েছেন।
আগের দিন যারা ফেসবুকে সন্তানের বৃত্তির খবর দিয়েছিলেন, পরদিন বাদ পড়ার গ্লানির খবরটি আর দিতে চাননি। প্রথম আলোর প্রধান আলোকচিত্রী ফেসবুকে তার স্ত্রী সুমাইয়া খান আশার একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করেছেন, ‘আমার ছেলে জাঈম ওর স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার খুব উল্লসিত থাকার কথা। কিন্তু পারছি না, কারণ সংশোধিত ফলাফলে ওর স্কুল থেকে ১০ জন শিশুর নাম বাদ পড়েছে।
একদিন আগেও যারা বৃত্তি পেয়েছিল তাদের নাম বাদ পড়েছে। ১০ বছরের একটা বাচ্চার কাছে আপনারা কি পরিমাণ ম্যাচুরিটি আশা করেন? তারপর বোনাস হিসেবে রোস্টিং, বুলিং তো আছেই। কতটুকু মানসিক চাপে থাকবে বাচ্চাগুলো। কারিগরি ত্রুটি সংশোধন করা যায়, কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো এই আঘাত কীভাবে সামলাবে? তাই আমার ছেলে বৃত্তি পেয়েছে বলে আমি উদযাপন করবো না, আমি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ার অপেক্ষায় আছি। ভালো কিছুর প্রত্যাশায়।’
Advertisement
কুমিল্লা থেকে পলি আহম্মেদ আমার ইনবক্সে নিচের বার্তাটি পাঠিয়েছেন, ‘আমার সন্তান সাইফুল্লাহ, কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলাধীন আড়াইওড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক বৃত্তি পরিক্ষা ২০২২ এ অংশগ্রহণ করে এবং পরীক্ষা শেষে জানায় যে তার পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। আমি তার ফলাফল নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলাম।
২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ফলাফলে সাধারণ গ্রেডের তালিকায় নাম আসে তার। তার এই ভালো ফলাফলে যেমন আমরা খুশি হই, তেমনি সেও আরও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। পাড়া-প্রতিবেশীসহ তার নতুন বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও সহপাঠী তাকে অভিবাদন জানায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ও পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, প্রাথমিকের কর্তা মহল তাদের প্রথমবারের কৃত ভুলকে সংশোধন করতে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় আরও বড় ভুল করে বসে আছেন। যেখানে মন্ত্রী মহোদয় নিজের মুখে বলেছিলেন, যারা বৃত্তি পেয়েছে তাদের ফলাফল বহাল থাকবে, এখন শুধু কোডিংয়ের কাজ করা হবে।
তাহলে দ্বিতীয় দফার সংশোধিত ফলাফলে কেন আমার সন্তানের রোল আসলো না? কেন কোমলমতি শিশুদের আবেগ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আজ যদি এর বিরূপ কোনো প্রভাব আমার সন্তানের ওপর পড়ে, এর দায়ভার কে নেবে? আমি এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান চাই। ২ মাস সময় নিয়ে যে ফলাফলে আমার সন্তান বৃত্তি পেলো, কর্তৃপক্ষের পাপমোচনের নিমিত্তে একদিনের ব্যবধানে তা কীভাবে ম্লান হয়ে যায়? পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যারা পূর্বে বৃত্তি পেয়েছিল তাদেরটা বহাল রাখা হোক এবং কোমলমতি শিশু প্রাণ নিয়ে যারা এমন প্রহসনের খেলা খেলছে তাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’ আশা বা পলির এই কান্না, এই হাহাকার, এই দাবি, এই প্রশ্নের কোনো জবাব কি আছে আমাদের বড়দের কারও কাছে?
স্কুলে স্কুলে, ঘরে ঘরে এমন হাহাকার, শিশুদের কান্না। একবার বৃত্তি পেয়ে পরে বাদ পড়ার গ্লানিটুকু সবাই প্রচার করতে চান না। অনেকেই এই অপমানটুকু গিলে ফেলতে চাইছেন। তাই আমরা আসল সংখ্যাটা জানছি না। কিন্তু শিশুদের মনে আঘাত লাগলো, তা কি সেই শিশুটি জীবনে ভুলতে পারবে? শিশু কেন, এমন অপমান তো বড়দের পক্ষেই সামলানো কঠিন।
আমি বৃত্তির তালিকা থেকে বাদ পড়া সেই শিশুদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। এই দায় আমাদের সবার। তবু আমি সেই শিশুদের অনুরোধ করছি, প্লিজ বড়দের এই অসংবেদনশীল আচরণে তোমরা মন খারাপ করো না। জীবনটা অনেক বড়। এই ব্যর্থদের দেওয়া ফলাফলে বৃত্তি পাওয়া না পাওয়ায় এই জীবনের কিছু যায় আসে না। আর অভিশাপ দিচ্ছি, যারা এই ফলাফল প্রস্তুত করার সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের সবাইকে।
তবে নিছক অভিশাপ দিয়েই থেমে থাকার মতো অপরাধ এটি নয়। প্রথম কথা হলো, মঙ্গলবার ঘোষিত ফলাফলের পুরোটা বহাল রাখতে হবে। সাথে যদি বৃত্তি পাওয়ার মতো মেধাবী আরও কিছু শিক্ষার্থী যুক্ত হয়, আপত্তি নেই। আর যারা পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পেয়েছে, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হোক। মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করেছে। কিন্তু তাদের তদন্তে আমার ভরসা নেই। তদন্ত কমিটি করাই হয়, প্রাথমিক ক্ষোভ প্রশমনের জন্য।
আমি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। আর বৃত্তির তালিকা থেকে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা চুপ করে থাকবেন না। আপনার সন্তান কোনো অপরাধ করেনি, ভুল করেনি। আপনারা সোচ্চার হন। সবাই দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করুন, হাইকোর্টে রিট করুন। দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করুন। কথা দিচ্ছি, আমি আপনাদের পাশে থাকবো। নিজেদের অদক্ষতার, ব্যর্থতার গ্লানি যারা শিশুদের মনের ভেতরে খোদাই করে দিলো, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। ৫ মার্চ, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন, নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম