মতামত

স্কুল শিক্ষায় পরখ ও পাঠবৈরাগ্য

কিছুদিন পর পর স্কুল শিক্ষার পরীক্ষাব্যবস্থায় নানা পরখ বা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন বছর ২০২৩ শুরু হতে না হতেই জেএসসি, জেডিসি নামক স্কুল পাবলিক পরীক্ষা বাদ দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। পরীক্ষা নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, কোচিং, নোট-গাইড বাণিজ্যসহ আরও নানা অনিয়ম ঠেকাতে এই পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিল করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাতঙ্ক ও এটারাক্সিয়া বা পাঠবৈরাগ্য সৃষ্টি হচ্ছে, যা ওদের জন্য সুখকর নয় এবং জাতির জন্যও অশনি সংকেত।

Advertisement

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত তিন বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বা পিএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। জুনিয়র ও দাখিলের শিক্ষা সমাপনী বা জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি। তার ওপর আকস্মিকভাবে চালু করা হয়েছে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়নি পরীক্ষার্থীরা। ঘোষিত বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে সমালোচনা চলার মাঝে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার সংবাদে নানা নতুন আলোচনা-সমালোচনা জন্ম নিয়েছে।

সেই ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই পিএসসি পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে শুরু করা হয়েছিল। এর একবছর পর ২০১০ সালে জেএসসি ও জেডিসির সমাপনী পরীক্ষাও পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে শুরু হয়ে যায়। এসব পরীক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার সাথে সাথে সাড়ম্বরে শুরু হয় কোচিং ও গাইডবই বিক্রির ব্যবসা। স্কুলের শিক্ষকসহ একটি মহল নানা স্তরের শিক্ষাবাণিজ্য করার উপকরণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব নিয়ে তখন ততটা ভাবনার উদ্রেক হয়নি। কারণ এতগুলা পাবলিক পরীক্ষার সুফল-কুফল নিয়ে গভীরে ভাবার অবকাশ নেওয়ার আগেই এগুলো নির্দেশিত হয়ে বাস্তবে রূপ নিয়ে ফেলেছিল।

তখন সরকারিভাবে বলা হয়, ‘সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে বোর্ডের পরীক্ষার ভীতি দূর করা এবং মেধাবী ও দরিদ্রদের মাঝে বৃত্তির নিয়মানুযায়ী বৃত্তি প্রদানের সুবিধার্থে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা ২০০৯ সালে চালু করা হয়।’

Advertisement

সরকারিভাবে ২০১৭ সালে পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘এ দুটি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মাঝে এসএসসি পরীক্ষার জন্য আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। ...তবে হঠাৎ এ দুটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনা শুরু হয়ে গেলো এবং এই পরীক্ষা বন্ধ করারও দাবি উঠলো। কিন্তু তাদের এই দাবি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।’ (বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য ৩১.০১.২০১৭)।

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালে পিএসসি, জেএসসি ও জেডিসি জন্য সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও মাঠ পর্যায়ের পরিবেশ উভয়ই বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল।

প্রথম দিকে এসব পরীক্ষা নিয়ে কোনো বড় সমস্যা হয়নি। পরবর্তীসময়ে বেশ কয়েক বছর চারদিকে এর গুণগান নিয়ে প্রচারণা বেশি ছিল বিধায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন হতে থাকে বেশি করে। কোচিং, প্রশ্নফাঁস ইত্যাদি সমস্যাগুলো তখন ততটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। নোট-গাইডের পক্ষের লোকজন তখন মহাখুশি ছিল। দেশীয় গণমাধ্যমে তেমন প্রচারণা ছিল না। তাই অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা থাকলেও ইউনেস্কো বা আন্তর্জাতিক মহলে এসব পরীক্ষার দুর্বলতা নিয়ে ততটা প্রচারণা হয়নি।

সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার আজ তের বছর অতিক্রম হয়েছে। আজ থেকে দুই বছর পূর্বে গত ২৩ জানুয়ারি ২০২১ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন আয়োজিত এক সভায় ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থেকে অনেক বিজ্ঞজনরা এসব পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য জোর সমালোচনা করেছিলেন।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীণ গভর্নর বলেছিলেন, ‘কোচিং, নোট-গাইডের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষার জন্য স্থায়ীভাবে এসব পাবলিক পরীক্ষা বাদ দেয়া উচিত।’ বক্তারা বলেন, দুই শিফটে পাঠদানের পরিবর্তে একশিফটে বেশি সময় পড়িয়ে অতিরিক্ত সময়ের জন্য শিক্ষকদের মূল বেতনের সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধাদি দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

তবে ধীরে ধীরে এটাকে বাদ দেওয়ার জন্য আরও যুক্তি আসতে থাকে। অনেকে সোচ্চার হয়ে প্রচারণা চালাতে থাকে। ভুক্তভোগী অভিভাবকরা এ ব্যাপারে সাড়া দিতে থাকেন। কারণ চারটি পাবলিক পরীক্ষার চাপ ছাড়াও স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার চাপে দিশেহারা কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

এনিয়ে তাদের অভিভাবকরা গভীর চিন্তিত ও একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। অল্প বয়সে এত এত পাবলিক পরীক্ষার সনদের জন্য আপ্রাণ লড়াই করাটা অনেকে বাচ্চাদের সুকুমার বৃত্তি ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে চিহ্নিত করেছেন। তাদের পিঠে চাপানো হয় বইয়ের বোঝা, বাড়ে হোমওয়ার্কের চাপ। এটা শিক্ষার্থীদের স্কুলভীতি ও পাঠাতঙ্ক তৈরি করে।

ফলে কোচিং করানো ও প্রাইভেট টিউটরের কাছে নির্ভরশীলতা চলে আসে এবং পড়াশোনার খরচ বেড়ে যায়। এই দ্রব্যমূল্যে সন্ত্রাসের বাজারে বাড়তি খরচের বোঝায় হিমশিম খেয়ে পড়েন অনেক অভিভাবক। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়।

আরও একটি বড় বিষয় হলো- তাড়াতাড়ি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের নামে শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করা। ফলে সামান্য পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেওয়ায় জ্ঞান অর্জন করার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। যেনতেনভাবে বেশি জিপিএ নিয়ে সনদ পাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় চারদিকে। জিপিএ নিয়ে এই হীন প্রতিযোগিতা অবলোকন করে একজন নাট্যাভিনেতা-মন্ত্রী এটাকে ‘জিপিএ ফাইভ নির্যাতন’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

এছাড়া স্বল্প সময়ে অনেকগুলো পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ণ করতে বলা হয়, যা অনেক পরীক্ষকই ভারো চোখে দেখেননি। তারা দ্রুত খাতা দেখার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে স্ক্রিপ্ট ভালোমতো না পড়ে গড়পড়তা নম্বর দিয়ে জিপিএ ফাইভ ও গোল্ডেন দিতে শুরু করে দেন, যা বিব্রতকরই নয় চরম ক্ষতিকর। এছাড়া ফলাফলে এত ভুল, এজন্য এত মামলা-পুনঃযাচাই আবেদন শুরু হয়, যা আগেকার দিনের পরীক্ষায় কখনও জমা দিতে দেখা যায়নি। এসব সংশোধন করাতে গেলে বোর্ড কর্মচারীদের নাভিশ্বাস উঠে এবং ঘুস-দুর্নীতি বেড়ে যায়।

জিপিএতে পাঁচে পাঁচ পাওয়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করতে থাকে। কারণ দামি সনদ পেলেও আসলে তাদের জ্ঞানের পিপাসা তৈরি হয়নি। শিক্ষকরা এ ব্যাপারে অনেক উদাসীন থাকেন। কারও কাছেই যেন মেধা ও জ্ঞানের কোনো মূল্যায়ন নেই।

তাই তো স্কুলের বিভিন্ন বার্ষিক অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মূল্যবান মেধাজাগানিয়া স্মৃতি পুরস্কার বই বা মেডেল-ক্রেস্ট পুরস্কার না দিয়ে এর পরিবর্তে পার্থিব পেটপূজার জন্য থালা-বাটি, জগ-মগ পুরস্কার দেওয়ার বিধান চালু হয়েছে অনেক বিদ্যালয়ে। ইতোপূর্বে এসব নিয়ে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও স্থানীয় অভিভাবকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল।

একদিকে পড়াশোনার চাপ অন্যদিকে অযাচিত নানা সমস্যার প্রভাবে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও একস্ট্রা কারিকুলার কাজে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত বন্ধ হয়ে যায়। এটাই বড় বাস্তবতা। এতগুলো সমস্যা ও এসব সমস্যাসৃষ্ট বিড়ম্বনাগুলো আগে গভীরভাবে কারও মাথায় আসেনি কেন এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়।

তাই তো বার বার শিক্ষা নিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এত বছর পরে আবার পুরোনো সিস্টেমে ফিরে যাওয়া কতটুকু সাশ্রয়ী ও সুখকর হবে তা সময় বলে দেবে। কারণ, একসময় পুরোনো পরীক্ষাব্যবস্থাপনার দুর্বলতা থেকেই বেশি বেশি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে আবার সেই অতীতের দুর্বলতাগুলো যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাথায় নতুন করে জেঁকে না বসে সেদিকে নজর বাড়াতে হবে। তা না হলে বার বার নতুন আদেশ-নিষেধ ‘পরখ’ করতে থাকলে শুধু পাঠাতঙ্ক ও এটারাক্সিয়া বা পাঠবৈরাগ্য সৃষ্টি করবে না বরং ঝরে পড়ার বিড়ম্বনা বাড়াতে থাকবে। এভাবে মূল্যবান সময় নষ্ট হতে থাকলে শিক্ষার গুণগত মান সৃষ্টির ভিত্তি তৈরি হবে কখন, আর বাচ্চারা প্রকৃত শিক্ষা পাবে কীভাবে?

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/এমএস