একটি ‘ওয়ান্ডার ড্রাগ’- যা আবিষ্কৃত হওয়ার আগে গোটা পৃথিবীতে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৪৭ বছর। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন, মাত্র ৪৭ বছর! বলছি এমনই এক জাদুকরী বিস্ময়ের, যাকে-কিনা একটা সময় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলনা করা হয়েছিল। শুধু কি তাই? সেটি আবিষ্কৃত না হলে হয়তো মানব ইতিহাস অনেক আগেই মুখ থুবড়ে পড়তো।
Advertisement
মানব ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা এই প্রতিষেধকটি প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল, ‘দ্য ব্লাডিয়েস্ট কনফ্লিক্ট অফ দা হিস্ট্রি’ খ্যাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে! এতক্ষণে নিশ্চই অনেকেই বুঝতে পেরেছেন, কি সেই আশীর্বাদ, কিসের কথা বলছি এতক্ষণ! ঠিকই অনুমান করেছেন, বলছি মানব ইতিহাসের জীবনরক্ষাকারী এক পার্থিব বিস্ময়- অ্যান্টিবায়োটিকের কথা, যাকে মানা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক ফলপ্রসূ প্রতিষেধক হিসেবে।
১৯২৮ সালে স্যার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের হাত ধরে আবিষ্কৃত হওয়া পেনিসিলিনের কথা তো আমরা সবাই কম বেশি জানি। কিন্তু জানি কি অ্যান্টিবায়োটিকের আরো পুরোনো ইতিহাস? অনেকেই ভাবেন পৃথিবীতে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংই প্রথম যার হাত ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের পথচলা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? চলুন না দেখে আসি ঘটনার আরও একটু গভীরে, জেনে নেই অ্যান্টিবায়োটিকের আরো পুরোনো একটু ইতিহাস।
১৮৭৪ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করে এক শিশু। ছেলেবেলা থেকেই কৌতুহলপ্রবণ আর অদম্য প্রতিভাবান শিশুটির নাম রাখা হয় আর্নেস্ট ডুশেনসে। ছেলেবেলা পার করে ১৮৯৪ সালে স্নাতক সম্পন্ন করতে যুবক ডুশেনসে যখন ভর্তি হন ফ্রান্সে অবস্থিত মিলিটারি মেডিকেল স্কুল অব লায়নে, তখন কে জানতো, এই বিদ্যাপীঠে ভর্তি হতে আসা সাধারণ সেই যুবকের নামই একদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করবে! কে জানতো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আর জীবন রক্ষাকারী প্রতিষেধক, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রসঙ্গ আসলেই উচ্চারিত হবে তার নাম!
Advertisement
স্বভাবতই মিলিটারি মেডিকেল স্কুলে পড়তে আসার পর থেকেই আর্নেস্ট ডুশেনসে সুযোগ পান দেশ বিদেশের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং মেশার। কেননা, দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য রোগী আসতো সেই মিলিটারি মেডিকেল স্কুল থেকে সেবা নিতে। স্বভাবসুলভভাবে কৌতুহলী, যুবক আর্নেস্ট ডুশেনসে সেইসব সেবাপ্রার্থী রোগীদের খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করতেন, গল্প করতেন, জানতে পারতেন তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কেও।
এভাবেই তিনি একদিন খেয়াল করলেন, আরব দেশ থেকে ঘোড়ায় চেপে আসা বেদুঈনেরা সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের ঘোড়াগুলোর পিঠ থেকে জিনগুলো খুলে রাখে একটি ঘরে। তবে ঘরটি সাধারণ নয়, বরং অন্ধকার আর আর্দ্র। কৌতুহলী ডুশেনসে এ বিষয়টি বেশ ক’দিন ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করার পর একদিন আরব বেদুঈনদের জিজ্ঞেস করলেন ঘোড়ার জিনগুলোকে এভাবে অন্ধকার আর আর্দ্র ঘরে রেখে দেওয়ার কারণ। উত্তরে তিনি যা শুনলেন তা ছিলো যুগান্তকারী এবং ডুশেনসের চিন্তার পালে নতুন উদ্দীপনী হাওয়ার সঞ্চালক।
আরব সেই ঘোড়াসওয়ারেরা ডুশেনসেকে জানালেন, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছাতে ঘোড়াগুলোর খুব কষ্ট হয়, কেননা ঘোড়াগুলোর ত্বকে এক ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই-নয়, ঘোড়াসওয়ারদের নিজেদের ত্বকেও দীর্ঘক্ষণ ঘোড়ার পিঠে চেপে থাকলে ঘর্ষণের ফলে ফোসকার মতো ক্ষত তৈরি হয়। ঘোড়ার জিনগুলো খুলে এভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আর্দ্র পরিবেশে রাখলে তাতে এক প্রকার ছত্রাক জন্মায় যা কি-না ঘোড়াগুলোর এবং ঘোড়াসওয়ারীদের ত্বকের সেই ক্ষত সারিয়ে তোলে নিমেষেই।
কথাগুলো জেনে ডুশেনসে এতটাই প্রভাবিত হয়ে যান যে তিনি তার ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার ভেতরকার সেই কার্যকলাপ গবেষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি ঘোড়াগুলোর জিন থেকে তৈরি হওয়া সেই মোল্ড বা পেনিসিলিয়াম গ্লাকাম এবং টাইফয়েড জ্বরের ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে নিরীক্ষণ করতে চান যে বাস্তবিক অর্থেই এই মোল্ড, ব্যাক্টেরিয়ার সাথে পেরে ওঠে কি-না।
Advertisement
প্রথমে ডুশেনসে কিছু পিগের (শুকরের) শরীরে টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করান এবং স্বাবভাবিকভাবেই শুকরগুলো মারা যায়। এরপর তিনি আবারও একই কাজ করেন কিন্তু একটু ভিন্ন কায়দায়। তিনি এবার কিছু শুকরের শরীরে টাইফয়েডের ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশ করান ঠিকই কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ঘোড়ার জিন থেকে তৈরি হওয়া সেই ছত্রাক বিশেষ বা মোল্ড সলিউশনটিও ইনজেক্ট করেন তাদের শরীরে। এতে করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা ছিলো রীতিমতো অভাবনীয় ও বিস্ময়কর!
শুকরগুলোর শরীরে টাইফয়েডের জীবাণু প্রবেশ করানোর ফলে তারা প্রথমদিকে অসুস্থ হলো বটে, কিন্তু মোল্ড সলিউশনটি প্রবেশ করানোর সাথে সাথেই তাদের সুস্থ হতেও বেশি সময় লাগলো না। আর তখনই ডুশেনসে বুঝতে পারলেন যে এই মোল্ড সলিউশনটি, টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে অতিশয় কার্যকরী এবং সক্ষম।
এই অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে ডুশেনসে এক মুহূর্ত দেরি না করে কঠোর পরিশ্রমে ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাকের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং এক পর্যায়ে তার ডক্টরাল থেসিস পেপারও তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু এরপর যা ঘটলো তা একধাপে মানব ইতিহাসকে ৩২ বছর পিছিয়ে দিলো এবং পরিগণিত হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা হিসেবেই।
“contribution to the study of vital competition in micro-organism: antagonism between molds and microbes” নামে ডুশেনসের ডক্টরাল থিসিস অবহেলিত হলো ওপর মহলে। তার এই মেডিকেল প্রতিবেদনটি যে ফলপ্রসূ হতে পারে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে সময়। তাদের ভাষ্যমতে, আর্নেস্ট ডুশেনসে যেহেতু নিতান্তই ২৩ বছরের যুবক এমনকি কোনো মেডিকেল ডিগ্রিও অর্জন করতে পারেননি সুতরাং এই থিসিস পেপার নিয়ে মাথা ঘামানোটা আসলে নির্বুদ্ধিতা ও বাতুলতা।
আসলে তখন কেউ ভাবতেই পারেনি যে মোল্ড কখনও ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারে! শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির গোঁড়ামির কারণে, স্যার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের ৩২ বছর আগে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেও আর্নেস্ট ডুশেনসে পেলেন না কোনো স্বীকৃতি। এক আবিষ্কার হওয়া ওষুধের জন্যই পৃথিবীকে আবার অপেক্ষা করতে হল দীর্ঘ ৩২টি বছর, কত মানুষ বেঘোরে মারা পড়লো, অল্প অসুখেই আয়ু নিভে গেলো কত তাজা প্রাণের!
ডুশেনসে একদিন মেডিকেল ডিগ্রি লাভ করলেন, কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের ফলে শত ব্যস্ততার ভিড়ে তার সেই থিসিস পেপারটিকে আর এগিয়ে নিতে পারলেন না। সেটি পড়ে রইলো ল্যাবরেটরির ময়লা আর ধুলোমাখা জঞ্জালের ছোট্ট এক কোণে। এর মধ্যেই ডুশেনসে বিয়ে করলেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার প্রাণপ্রিয় সঙ্গিনী আক্রান্ত হলেন টিউবারকিউলসিসে (যক্ষা, একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত মরণব্যাধি) এবং মৃত্যুবরণ করলেন।
স্ত্রী’র এই অকাল প্রয়াণ, সইতে পারলেন না ডুশেনসে নিজেও। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন এবং ক্রমেই শারীরিকভাবেও অসুস্থ হতে থাকলেন। অসুস্থ অবস্থায়ই ১৯১২ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ডুশেনসেও মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তিনি নিজেও টিউবারকিউলোসিসের দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ডুশেনসের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর এবং আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কারেরও দীর্ঘ ৫০ বছর পর একজন লাইব্রেরিয়ান খুঁজে পান তার সেই পুরোনো থিসিস পেপার যা একদিন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। কিন্তু এত দীর্ঘ বিলম্বে, ততদিনে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং প্রথম পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে। ঘটনাক্রমে ১৯৪৬ সালে ডুশেনসের সেই মেডিকেল স্কুল থেসিসটি সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশিত হয়। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, আর্নেস্ত বরিস চেইন এবং হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ৫ বছর পর, ১৯৪৯ সালে আর্নেস্ট ডুশেনসেকে মরণোত্তর সম্মাননাও দেওয়া হয়।
তবে এটুকুই অ্যান্টিবায়োটিকের একদম শুরুর দিকের কথা নয়! মজার বিষয় হলো, প্রাচীনকাল থেকেই আসলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়ে আসছে। ২০০০ বছর আগের মিশরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে গ্রিস, চীন ও সার্বিয়া অঞ্চলেও বিভিন্ন সংক্রামক রোগ সারাতে ‘মাইক্রোবেস’ (যা অ্যান্টিবাইয়োটিক তৈরি করে) ব্যবহৃত হতো।
খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৫০ অব্দে লেখা ‘দ্য এবার’স প্যাপিরাস’ নামে একটি মিশরীয় মেডিকেল প্যাপিরাস পাওয়া যায়। সেই প্যাপিরাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা নানান সংক্রামক ব্যাধি সারাতে, ছত্রাক আক্রান্ত পাউরুটি ও রোগ নিরাময়ের জন্য এক প্রকার বিশেষ মাটি ব্যবহার করতেন।
অন্যদিকে, গিলান বেল্কের ব্লগ, ‘দ্য সিক্রেট অব অ্যানশিয়েন্ট বিয়ার’ এ উল্লেখ আছে যে মিশরীয়দের হাড়ে ‘‘Traces of Tetracycline’’ নামক এক ধরনের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় আরোও জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা এক ধরনের পুরোনো বিয়ার পান করতো যাতে থাকত টেট্রাসাইক্লিন। অর্থাৎ ব্যাপারটি যা দাঁড়াচ্ছে, নিজেদের অজান্তেই প্রাচীন মিশরীয়রা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করত।
এবার আসি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গে। অ্যান্টিবায়োটিকের কথা উঠলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসবে না এ হতেই পারে না। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত ধরেই সর্বপ্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ল্যাবের বাইরে এসে বিভিন্ন ফার্মেসিতে স্থান পেয়েছে। অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং খুঁজে পেয়েছিলেন পেনিসিলিয়াম নোটাটাম ঠিকই কিন্তু তিনি তা শোধন করে মানুষ বা প্রাণীর ব্যবহারোপযোগী করে রেখে যাননি।
তাই ল্যাব থেকে বের হয়ে মানুষের হাতের নাগালে আসতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি অ্যান্টিবায়োটিককে। আর এ দীর্ঘ, ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় যে ক’জন ব্যক্তি সর্বক্ষণ পাশে থেকেছেন তারা হলেন অক্সফোর্ড গবেষক দলের অক্লান্ত পরিশ্রমী সদস্যরা, হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরে, আর্নেস্ত বরিস চেইন, নরম্যান হিটলি, এবং জিম কেন্ট । তাদের আপ্রাণ চেষ্টার ফলেই মূলত পেনিসিলিনের বা দুনিয়ার প্রথম অ্যান্টয়িবায়োটিকের প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয় ও ক্রমেই তা সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো যুদ্ধেই সৈনিকেরা বিভিন্নভাবে কাটা-ছেঁড়া ও সংক্রামক রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হত। সুচিকিৎসার অভাবে এই সংক্রামক ব্যধিগুলোই ছিল সৈন্য মৃত্যুর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কারণ। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সৈন্যদের বাঁচিয়ে রাখাটা কিন্তু একইসাথে ছিলো সবপক্ষের জন্যই চ্যালেঞ্জিং আবার যুদ্ধজয়ের পূর্ব শর্ত।
তবে, পেনিসিলিন যে যুদ্ধজয়ের অদৃশ্য হাতিয়ার হতে চলেছে সেটা বুঝতে আমেরিকার খুব বেশি সময় লাগেনি। আর আমেরিকাকে এই বিষয়টি উপলব্ধি করানোর পেছনে অক্সফোর্ড গবেষকদলটিই ছিলো মুখ্য ভূমিকা পালনকারি হিসেবে। এবার তবে জানা যাক, কিভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হলো আর কিভাবেই বা তা ল্যাব্রেটরি থেকে বাইরে এসে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছালো।
১৯৩৯ সাল থেকেই অক্সফোর্ডের প্যাথললি চেয়ারম্যান ফ্লোরের নেতৃত্বাধীন এই গবেষকদলটি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো পেনিসিলিনকে সাধারণ মানুষ ও প্রাণীর জন্য ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে। এর-ই নিরিখে ২৫ মে, ১৯৪০ সালে তারা সর্বপ্রথম ৮টি ইঁদুরের উপর অ্যান্টিবায়োটিকের পরীক্ষা চালায়। এই পরীক্ষাটি করা হয় কয়েক দফায়। প্রথমে ইঁদুরগুলোর শরীরে স্ট্রেপটোকোকি ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে তাদের দুইভাগে ভাগ করা হয়।
তারপর এক ভাগের ওপর গবেষকদল পেনিসিলিন প্রয়োগ করেন, অন্যভাগের ওপর করেন না। এর ফলে পরদিন সকালে অর্থাৎ প্রায় ১৮ ঘণ্টা পরে দেখা যায় যেসব ইঁদুরগুলোর ওপর পেনিসিলিন প্রয়োগ করা হয়নি তারা সবাই মারা গেছে। উপরন্তু পেনিসিলিন পাওয়া ইঁদুরগুলো তখন অবধি জীবিত ছিলো এমনকি পরে তারা অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থভাবেই বেঁচে ছিলো। এ রকম ফলাফলের পরে, ফ্লোরে ভাবলেন এখনই সময় পেনিসিলিন মানুষের ওপর পরীক্ষা করার। কেননা ইঁদুরের চেয়ে মানুষ যেহেতু ৩০০০ গুণ বড় সেহেতু ফ্লোরে খুব ভালোভাবেই জানতেন শুধুমাত্র ইঁদুরের ওপর এর পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিন্ত থাকাটা বোকামি।
এদিকে ১৯৪১ সালে তাদের কাছে খবর আসে অ্যালবার্ট আলেক্সান্ডার নামে একজন পুলিশ সদস্য গুরুতর অবস্থায় ভর্তি আছেন হাসপাতালে। যদিও প্রথমদিকে তিনি ভর্তি হন সামান্য কাঁটাছেড়া নিয়ে কিন্তু পরে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। অনেকের মতে আলাকজান্ডারের মুখে গোলাপের কাঁটা ঢুকে পড়ে।
আবার অনেকে মনে করেন নাৎসি বাহিনীর বোমার আঘাতেই আহত হয়েছিলেন অ্যালেক্সান্ডার। সে যাই হোক, কেউ অনুমানই করতে পারেনি, তার এই সামান্য জখম একসময় ছড়িয়ে পড়বে পুরো শরীরে এমনকি এক পর্যায়ে তা প্রাণসংহার করে নেবার পর্যায়ে চলে যাবে।
ফ্লোরে সিদ্ধান্ত নেন অ্যালবার্ট অ্যালেক্সান্ডারই হবেন প্রথম মানুষ যার ওপর প্রয়োগ করা হবে এই অ্যান্টিবায়োটিক। সে মোতাবেক, ৪ দিন অন্তর অন্তর প্রতিনিয়ত অ্যালেক্সান্ডারের শরীরে পেনিসিলিন প্রবেশ করানো হয়। এতে দেখা যায় প্রথম ২৪ ঘণ্টায় মরণাপন্ন অ্যালেক্সান্ডার কিছুটা সুস্থ বোধ করেন।
আস্তে আস্তে সেরে উঠতে থাকেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন গবেষকদল পেনিসিলিনের অপ্রতুল উৎপাদন ও ব্যাপক চাহিদার মাঝে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হলেন। তারা অ্যালেক্সান্ডারের মূত্র থেকে পেনিসিলিন পুনঃরায় ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কিন্তু এভাবেও খুব বেশি দিন চালানো গেলো না। পেনিসিলিনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলো। আর তার ঠিক এক মাস পরেই অ্যালবার্ট অ্যালেক্সান্ডারও মারা গেলেন।
এই ঘটনার পর, ফ্লোরে পেনিসিলিনের প্রচুর উৎপাদন ও তার সাথে ব্যাপক পরিসরে হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্টনারশিপ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। মিত্র বাহিনিকে যুদ্ধে জেতাতে অক্সফোর্ডের এই গবেষকদল পেনিসিলিনের ব্যাপক পরিসরে উৎপাদন চালু করার চেয়ে ভিন্ন কোনো উপায় সামনে দেখলেন না। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগে বাঁধ সাধে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সমস্যা।
কেননা এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যয় সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাজ্যের জন্য, তার ওপর পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদনের সম্ভাব্য খরচ! সব মিলিয়ে ব্রিটিশ কোনো কোম্পানি এগিয়ে আসলো না তাদের কাছে। উপরন্তু গবেষকদলের ভয় ছিলো এই ভেবে যে পেনিসিলিন উৎপাদনের প্রজেক্ট না জানি কখন নাৎসিদের হাতে চলে যায়।
এই ভয়টা এতই প্রকট ছিল অক্সফোর্ড গবেষকদের মধ্যে যে, পরবর্তীতে যখন বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, ফ্লোরে তাদের দলের সে সময়কার একটা ওর্স্ট কেইস স্ট্রাটেজি প্রকাশ করেন। যাতে তিনি উল্লেখ করেন, নাৎসি আক্রমণের আতংকে সর্বদা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে তারা পেনিসিলিয়াম নোটাটাম এর রেণু জামা কাপড়ে ঘষে রাখতেন, যেন নাৎসিরা আক্রমণ করলে যে যার মতো যেকোনো জায়গায় পালিয়ে গিয়ে এই রেনুর সাহায্যে যেকোনো অবস্থাতেই গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
ফ্লোরে সিদ্ধান্ত নিলেন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পেনিসিলিনের গুরুত্ব অনুধাবন করাবেন ও সমর্থন আদায় করে ব্যাপক পরিসরে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্লোরে তার দলের আরেক গুরুত্বপূর্ন সদস্য নরম্যান হিটলিকে নিয়ে পৌঁছালেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং এরপর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
দ্রুতই তারা পেয়ে গেলেন একটি নয়, দু’টি নয়, চার চারটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অংশীদার। প্রকৃতপক্ষে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে সেসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজেও চাইছিলো পেনিসিলিনকে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করার পর থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলো এবং চাচ্ছিলো যেকোনো উপায়ে এই যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের সংখ্যা কমাতে। আর একারণে তারা শুরুতেই পেনিসিলিনের উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছিলো।
শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেদেশের ২০ টি’রও বেশি কোম্পানিকে নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে পেনিসিলিন উৎপাদনের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪২ সালের জানুয়ারি থেকে মে অবধি ৪০০ মিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন উৎপাদন হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফার্মাসিটিক্যালসের।
উৎপাদন আরও বেড়ে গেলো ১৯৪৪ সালে যখন মিত্র বাহিনী নরম্যান্ডিতে আক্রমণ করলো। সে সময় প্রতি মাসে ১০০ বিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন উৎপাদিত হতে থাকলো। ১৯৪৪ সালে উৎপাদিত এই পরিমাণ পেনিসিলিন আসলে শুধুমাত্র যুদ্ধাহত সেনাদের জন্যই নয়, বরং যুদ্ধাহত সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্যও যথেষ্ট ছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি মাসে ৬৫০ বিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিলো। যা সে সময় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের মৃত্যুহার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করে।
তবে পেনিসিলিন উৎপাদনের কথা উঠলে, নরম্যান হিটলি’র নাম উল্লেখ করতেই হবে। তারই তত্ত্বাবধানে প্রথমদিকে পেনিসিলিন তৈরি হতো সমতল ও প্রশস্ত কালচার ডিশে। প্রথমদিকে হাসপাতালের বেডপ্যানগুলোও ব্যবহৃত হতো পেনিসিলিন উৎপাদনের কাজে। তারপর ধীরে ধীরে হিটলি’র কল্যাণে ডিপ কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত হতে থাকলো পেনিসিলিন।
প্রথম অবস্থায়, উৎপাদন স্বল্পতার কারণে পেনিসিলিন এয়ারমার্কড অবস্থায় থাকত ও তা কেবল সামরিক উদ্দেশ্যে সৈন্যদের উপরই ব্যবহৃত হতো। পেনিসিলিনের সবচেয়ে বড় পরিসরে যে হিউম্যান ট্রায়াল হয় সেটিও ছিল একটা মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতাল।
সে যাই হোক, যেখানে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই মাত্র ৪ শতাংশ সৈনিক বেঁচে ছিলো, সেখানে ‘দ্য ব্লাডিয়েস্ট কনফ্লিক্ট’ খ্যাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাহত ৫০ শতাংশ সৈনিকই বেঁচে গিয়েছিলো! সেই সময়কালের জন্য এটা আসলেই অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। পেনিসিলিন আবিষ্কারের আগে অর্থাৎ ১৯০০ শতকের পূর্বে, পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৪৬ বছর যেখানে নারীদের ছিলো মাত্র ৪৮ বছর। সেসময় বিভিন্ন অসুখ যেমন স্মল পক্স, টাইফয়েড, যক্ষা, কলেরা, ডিপথেরিয়া, প্লেগ, সিফিলিস, টাইপাসের মত বিভিন্ন সংক্রামক ও ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েই লোকালয় থেকে লোকালয় উজাড় হয়ে যেতো।
১৯৪০ এর দশক থেকে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত সময়কালকে অ্যান্টিবায়োটিকের স্বর্নালী যুগ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৭০ সালের পর অ্যান্টিবায়োটিকের নতুন আর কোনো ক্লাস তৈরি হয়নি বরং আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়টিকেগুলোকেই মডিফাই করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর, রোগাক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর কারণেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আগে যেমন বিভিন্ন সংক্রামণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু হত, এই আশ্চর্য প্রতিষেধকটি আসার পর মানুষের মৃত্যু হতে থাকলো বিভিন্ন অ-সংক্রামক ব্যধিতে যেমন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসারের মত রোগে। যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৭৮.৮ বছর পর্যন্ত বেড়ে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছিলো। আবার অ্যান্টিবায়োটিকের কল্যাণেই ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭২ সালে মধ্যে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছিলো ৮ বছর।
এমআরএম/জেআইএম