ফিচার

কফি পান করতে ভালো লাগে কেন?

কফি এখন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ পানীয়। ক্লান্তি রোধক তৃপ্তিকর পানীয় হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে কফি। তবে কবে এটি আবিষ্কার হয়েছে তা বলা খুব মুশকিল। প্রবাদ আছে, কয়েক হাজার বছর আগে আরব মুল্লুকের আবিসিনিয়ার এক অধিবাসী এক রাখাল এক ঝোঁপের কাছে এসে এক বিশেষ গন্ধে আকৃষ্ট হন। ঝোঁপে তখন আগুন লেগেছিল। তিনি ঝোঁপের কাছ থেকে এক ধরনের ছোট ছোট ফলের গোটার সন্ধান পান। সেগুলো চিবিয়ে খান। তার তেতো স্বাদ অনুভব করেন। তারপর কিছু ফল কুড়িয়ে এনে সেগুলোর জুস বা রস বানিয়ে খান। বেশ চনমনে একটা আমেজ অনুভব করেন দেহ-মনে। গবেষকরা বলেন, এভাবেই আবিষ্কার হয়েছে কফি।

Advertisement

পঞ্চাশ শতাব্দী পর্যন্ত আবিসিনিয়ার লোকেরাই এই কফির স্বাদ ভোগ করেন। গবেষকদের মতে, প্রথাগতভাবে কফি চাষ হয়েছে পাঁচশ বছর আগে আবিসিনিয়া অঞ্চলেই। ক্রমে এর প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। আফ্রিকার আবিসিনিয়া থেকে এই কফি আসে আরবের ইয়েমেনে। সেখান থেকে পৃথিবীর নানা স্থানে কফি সরবরাহ করা হয়। তখন এর প্রচলিত নাম হয়ে যায় কফি অ্যারাবিকা। সপ্তদশ শতাব্দীতে জাভাতে ডাচেরা কফি উৎপাদন শুরু করে। সেখান থেকে বিভিন্ন উষ্ণ অঞ্চলে কফির চারা রোপণ করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাবা বুডেম নামে একজন আরবীয় ভ্রমণকারী এই উপমহাদেশে কফির বীজ নিয়ে আসেন। তিনি সাধু-সন্ন্যাসি ছিলেন। তাই তিনি এক পাহাড়ি অঞ্চলে এসে বাস করা শুরু করেন। পাহাড়ের গুহার কাছে সেই বীজ মাটিতে রোপণ করেন। তার সেই কফি এই উপমহাদেশে ক্রমে ক্রমে প্রসার লাভ করে।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, কফি গাছের গণ-কফিয়া। গোত্র রুবিয়াসিঈ। কফি গাছ ছায়াঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো জন্মায়। মূলত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হৃষ্টপুষ্টভাবে ফল হয়। গুণাগুণ ভালোভাবে অক্ষুণ্ন থাকে। উর্বর মাটি বা বেলে দোআঁশ মাটিতে কফি উৎপাদন ভালো হয়। এই গাছের পাতা চকচকে সবুজ। কফি গাছের কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে কফিয়া অ্যারাবিকা এবং কফিয়া রোবাস্টা প্রধান। কফিয়া অ্যারাবিকা কফি গাছগুলোর প্রজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কফির চারা বড় হলে ছোট ছোট সাদা ফুল গাছে ফোটে। দূর থেকে সুন্দর দেখায়। কফি ফল সাধারণত বছরে একবার হয়ে থাকে। কফি বীজ থেকে কফি পানীয় তৈরি হয়।

আরও পড়ুন: আকাশে কত তারা?

Advertisement

বিজ্ঞানীদের মতে, চায়ের মতো হলেও কফি এক রকম মৃদু উত্তেজক পানীয়। কফিতে ক্যাফেইন নামে একধরনের দুর্বল উপক্ষার (অ্যালকালয়েড) থাকে। তাই এটি স্বাদে তেতো। এটি এক ধরনের মৃদু উত্তেজক পদার্থ। কফির ক্যাফেইন মানুষের দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ব্যাপক উদ্দীপ্ত করে। ফলে শারীরিক পরিশ্রমের পর ক্লান্তি দূর করতে এটি সহায়ক হয়। এ ছাড়া কফির মধ্যে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-বি। কফি বীজে বা ফলে ক্যাফেইন থাকে শতকরা পনেরো থেকে বিশ ভাগ পর্যন্ত। এই ক্যাফেইন আবার পিউরিন জাতীয় যৌগ থেকে পাওয়া যায়। পিউরিন হলো এক প্রকার জৈব জাতীয় পদার্থ। এমিল দিশার নামে এক রসায়নবিদ যৌগটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। ক্যাফেইনের রাসায়নিক নাম ট্রাইমিথাইল-ডাই-হাইড্রক্সি পিউরিন। ইউরিক অ্যাসিড থেকে ফিশার এই ক্যাফেইন প্রস্তুত করেন। ক্যাফেইন ও ইউরিক অ্যাসিডের গঠন কাঠামোতে মিল রয়েছে। কফি বা চায়ের অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে প্রধানত ক্যাফেইন উৎপাদন করা হয়। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা জানান, শুকনো কফি বীজে ০.৭৫-১.৫% ক্যাফেইন রয়েছে। যা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আর ক্যাফিডল কফির বিশেষ গন্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়।

বলা হয়ে থাকে, কফি যত শুকানো হয়; তত বেশি স্বাদ গন্ধময় হয়ে ওঠে। তত বেশি উত্তেজক হয়ে ওঠে। কফি গাছের ফল তুলে খোসা ছাড়িয়ে তারপর রোদে শুকানো হয়। কফি ফল সূর্যের তাপে শুকিয়ে, পরিষ্কার করা হয়। ফল বীজগুলো শুকিয়ে পাউডারে পরিণত করা হয়। এরপর একে গরম পানিতে ভেজানো হয়। পরে ঠান্ডা করে সেপারেটরের সাহায্যে পরিষ্কার করা হয়। ফলে সুন্দর গন্ধযুক্ত এবং উত্তেজক পানীয় কফি প্রস্তুত হয়। তারপরে গুঁড়ো করে প্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

পৃথিবীর কফি উৎপাদক অঞ্চলের মধ্যে আরবদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জাভা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, সালভাদোর, হাইতি, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার পশ্চিমতীর, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি বিখ্যাত। বাংলাদেশেও অনেকেই কফি চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন। পাঁচশ বছর আগে আবিসিনিয়া এবং আরবদেশ অঞ্চলে প্রথমে কফি গাছ দেখা গেলেও সেই কফি গাছ এখন ইসরাইল, শ্রীলঙ্কা, জাভা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ব্রাজিলে ছড়িয়ে পড়েছে। কফি ব্রাজিলে উৎপাদন হয় সব থেকে বেশি। ব্রাজিলে বিভিন্ন ধরনের কফি পাওয়া যায়। কোনোটির নাম রিও, কোনোটির নাম সানটোম। কলম্বিয়া, গোয়াতেমালা, মেক্সিকো, জাভা প্রভৃতি স্থানে কফির চাষ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। জাভাতে কফি উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের কফির নাম জাভা।

আরও পড়ুন: ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার উড়তে পারে যে মাছ

Advertisement

অবসাদ কমাতে সাহায্য করে কফি। অল্প-স্বল্প মাথা ব্যথায় একটি সাময়িক আরাম দেয় বলে আজকাল প্যারাসিটামল ওষুধে ব্যবহৃত হচ্ছে কফি। অসময়ে জরুরি দরকারে ঘুম বন্ধের ওষুধ হিসেবেও এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। কফি উত্তেজক পানীয় হওয়ার ফলে বর্তমান ডিজিটাল যুগের মানুষ চায়ের বদলে কফিতেই বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া কফি চকোলেট, কফি আইসক্রিম, ঠান্ডা কফিসহ বিভিন্ন বিস্কুটসহ বেকারির দামি খাবারেও আজকাল ব্যবহৃত হচ্ছে কফি। গবেষকরা সাবধান করছেন, বেশি কফি পানে ঘুম না আসা, ঘুম না আসায় ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেওয়া, রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া, পাকস্থলিতে ঘা হওয়া ইত্যাদি রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই উন্নত দেশগুলো বর্তমানে ক্যাফেইনমুক্ত (স্নায়ুর উত্তেজনা কম হয়ে থাকে) কফি খাওয়ার প্রচলন শুরু করেছে।

যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশ, গরম গরম কফি শুধু যে মন-প্রাণ চাঙা করে দেয়, তাই শুধু নয়। কফি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে শরীরের ওজন। ওজন কমানোসহ শরীর ও মন সতেজ রাখতে কফির জুড়ি মেলা ভার। সে সঙ্গে কফি থেকে এসব রোগের কবলে পড়ার সম্ভাবনা আর থাকে না। এ ছাড়া কফি খেলে ক্ষুধাও কম পায়। ফলে এই পানীয় পরোক্ষভাবে ক্যালোরি কমাতে সাহায্য করে এবং ওজন ঝরায়। টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের কোষকে প্রতিরোধ করে থাকে। জীবনীশক্তি বাড়ায়। আর চুল ও ত্বকের সৌন্দর্য বাড়াতেও সাহায্য করে।

অতএব অপেক্ষা কীসের? জাগো কফির স্বাদে। প্রতিদিন জাগো। ক্লান্ত অবসরে কাজের ফাঁকে হয়ে যাক কফি!

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এমফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস