কথিত নির্যাতনের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে অবৈধপথে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন দুই বাংলাদেশি। কিন্তু ধরা পড়ে যান অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর হাতে। এরপর তাদের পাঠানো হয় দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ছোট দ্বীপরাষ্ট্র নাউরুতে। অস্ট্রেলিয়া থেকে দ্বীপটিতে আকাশপথে যেতেও সময় লাগে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা। সেখানেই ভয়াবহ নরক যন্ত্রণার মধ্যে প্রায় ১০ বছর ধরে বন্দি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ কাইয়ুম নামে ওই দুই বাংলাদেশি।
Advertisement
এভাবে দীর্ঘদিন আটকে রাখার প্রতিবাদে তারা নিজেদের মুখ সেলাই করে দিয়েছেন। বন্ধ রেখেছেন খাওয়া-দাওয়া, কথা বলা।
সম্প্রতি আল-জাজিরাকে হোয়াটসঅ্যাপে লিখে নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়েছেন শফিকুল ও কাইয়ুম। তাদের শরণার্থী উল্লেখ করে বিশেষ প্রতিবেদন করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। যদিও এক্ষেত্রে আশ্রয়প্রার্থী শব্দ ব্যবহারই বেশি যুক্তিযুক্ত হতো। তাছাড়া, শফিকুল ও কাইয়ুম স্বদেশে কী ধরনের নির্যাতনের হুমকিতে ছিলেন, সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি।
আরও পড়ুন>> ইউরোপে আশ্রয় আবেদনে বাংলাদেশিদের নতুন রেকর্ড
Advertisement
আরপিসি১’র বাইরে শুয়ে রয়েছেন কাইয়ুম ও শফিকুল। ছবি সংগৃহীত
আল-জাজিরার খবর অনুসারে, যারা নৌকায় চড়ে অবৈধপথে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় চান, তাদের আটক করে নাউরুতে পাঠিয়ে দেয় অস্ট্রেলীয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সাল থেকে দ্বীপটিকে তারা আশ্রয়প্রার্থীদের আটকে রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে। নাউরু ছাড়া পাপুয়া নিউ গিনির (পিএনজি) মানুস দ্বীপেও কিছু আশ্রয়প্রার্থীকে পাঠায় অস্ট্রেলিয়া। এসময় জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা কোনোদিনই অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের অনুমতি পাবে না।
অস্ট্রেলিয়ার এই কঠোর অভিবাসন নীতি দেশটির শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে নাউরু ও পাপুয়া নিউ গিনিতে এ ধরনের ১৫০ জনের বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী বন্দি রয়েছেন। তারা জানেন না, কখন পুনর্বাসিত হবেন, আদৌ হবেন কি না।
আরও পড়ুন>> ইতালি উপকূলে নৌকাডুবি, ৫৯ অভিবাসনপ্রত্যাশী-শরণার্থীর মৃত্যু
Advertisement
এভাবে নাউরু দ্বীপে প্রায় ১০ বছর বন্দি শফিকুল ও কাইয়ুম। তারা এখন নাউরুর শরণার্থী পরিষেবা ও নিরাপত্তার জন্য তৈরি প্রশাসনিক কেন্দ্রের (আরপিসি১) বাইরে বিক্ষোভ করছেন। সেখান থেকেই শফিকুল তাদের বিক্ষোভের বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আল-জাজিরার কাছে বার্তা পাঠান।
মুখ সেলাই করে প্লাকার্ড হাতে দাঁড়ানো মোহাম্মদ কাইয়ুম। ছবি সংগৃহীত
তিনি বলেন, ‘আমরা অনশন শুরু করেছি। আমরা মুখ সেলাই করে নিয়েছি। খাবার গ্রহণ ও পানি পান বন্ধ। আমরা কথা বলতে পারি না।’ শফিকুল বলেন, ‘আমরা চিকিৎসা ও স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত খাবার-পানি স্পর্শ করবো না।’
আল-জাজিরা জানিয়েছে, শফিকুল ও কাইয়ুম ২০১৩ সালে পৃথকভাবে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যান। দুজনেই স্বদেশে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় চাইতে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন শফিকুল। তবে তাদের নৌকা আটকে দেয় অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনী এবং ঘটনাক্রমে নাউরুতে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন>> ইতালিতে অভিবাসীদের শোষণের অভিযোগ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে
কিন্তু দ্বীপটির পরিস্থিতি ‘নিরাপদ নয়’ বলে জানিয়েছেন শফিকুল। তিনি বলেন, ‘নাউরুতে আমাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়, মানুষের মতো নয়। এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা খুব খারাপ। আমরা এখানে নিরাপদ নই। এখানকার মানুষ শরণার্থীদের পছন্দ করে না। তারা আমাদের ঘৃণা করে।’
শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ান রেডক্রসের ব্যাখ্যা। ছবি সংগৃহীত
ক্যানবেরা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ২০১৬ সালের পুনর্বাসন ব্যবস্থার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শফিকুল ইসলাম। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতেও এরই মধ্যে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। শফিকুল বা কাইয়ুম কেউই জানেন না, তারা কবে ছাড়া পাবেন। কাইয়ুম অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের আবেদন করেননি। কিন্তু তারা দুজনেই দ্রুত নাউরু দ্বীপ ছাড়তে চান এবং অনির্দিষ্টকালের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে চান।
আরও পড়ুন>> শরণার্থীদের সরাসরি স্পন্সর হতে পারবেন মার্কিনিরা
শফিকুল বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। স্বাধীনতা প্রয়োজন। আমরা বিচার চাই। কেন কোনো অপরাধ ছাড়াই আমরা ১০ বছর ধরে নরকে রয়েছি? আমাদের মন ভেঙে গেছে। আর নিতে পারছি না। দয়া করে আমাদের মুক্তির জন্য সাহায্য করুন।’
কেএএ/