২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ২০টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০-র সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছে ভারত। বিশ্বমঞ্চে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে এবার। ভারতের যেকোনো শহর ঘুরলে সর্বত্র চোখে পড়বে জি-২০ সম্মেলন ঘিরে কর্মযজ্ঞ। গোলচত্বর, ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ ও বিমানবন্দরগুলো সাজানো হয়েছে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মূল সম্মেলন। সেই আয়োজনে অতিথি হিসেবে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশসহ ৮টি দেশ। এই সম্মেলনকে ঘিরে লোগোর নকশায় ভারতের জাতীয় ফুল পদ্ম ব্যবহার করা হয়েছে। সাত পাপড়ির এ পদ্মে সাত মহাদেশ ও সঙ্গীতের সাত স্বরকে ইঙ্গিত করা হয়। স্লোগান হিসেবে নেওয়া হয়েছে ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’।
Advertisement
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জি-২০-র আয়োজনে প্রচার প্রচারণা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ও তার দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করছে। ১ ও ২ মার্চ দিল্লিতে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের মাধ্যমে এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন> দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন/কোন দিকে এগোচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি?
ভারত বড় সমস্যা সমাধানের একটি ফোরাম হিসেবে জি-২০ কে প্রচার করতে চায়, যার সদস্যরা বিশ্বের জিডিপির ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশও নিয়ন্ত্রণ করে। ‘দক্ষিণের বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর’ এই সংগঠন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শক্তিশালী উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর জোর দিতে চায়। সর্বোপরি, এই আয়োজন মোদীর জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে যেখানে ভারত বড় বড় ব্যক্তিদের সফরে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা তুলে ধরা এবং পরের বছর সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছানো।
Advertisement
ভারতের জি-২০-র প্রেসিডেন্সির অফিসিয়াল এজেন্ডায় আছে দরিদ্র দেশগুলোর চাহিদার ওপর জোর দেওয়া, অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থায়ন, আরও ‘প্রতিনিধিত্বমূলক’ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রগতি সাধন। বলা যায়, করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে যে কাজগুলো স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সেগুলো পুনরায় সচল করা।
দিল্লির কাছে জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনালের জি-২০ নিয়ে গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহন কুমার। তিনি ফ্রান্সে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ভারত সম্ভবত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাবে না যা সে চায়, তাই এটি অন্যান্য ফোরামের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করছে।
ভারতের এই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবসম্মত? কিছু উপায় হিসেবে ভূরাজনীতি মোদীর অনুকূলে রয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলোও চায় ভারত একটি বড় বৈশ্বিক ভূমিকা পালন করুক। তারা এটিকে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি সম্ভাব্য সেতু হিসেবে দেখে। জো বাইডেন গত সপ্তাহে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ও মাস্টারকার্ডের সাবেক সিইও অজয় বাঙ্গাকে বিশ্বব্যাংকের প্রধানের জন্য মনোনীত করেন। ভারতকে তারা চীনের একটি গণতান্ত্রিক পাল্টা শক্তিও বিবেচনা করে। গত সপ্তাহে ভারত সফরে এসে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন ‘আমাদের দেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, আমাদের সাধারণ মতামত রয়েছে, বিশেষত যখন এটি গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।’
ভারত জি-২০-র আয়োজনে প্রশংসা পাবে। তবুও এটি তার লক্ষ্য পূরণ কতটা করতে পারবে সেটি সন্দিহান। কোনো সনদ এবং কোনো সচিবালয় ছাড়া একটি অনানুষ্ঠানিক গ্রুপিং, জি-২০-র কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য তার সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করে। এশিয়ার আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে গঠিত হয় ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর জি-৮ (এখন জি-৭)। ২০০৯ সালের এপ্রিলে একটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল, যখন সদস্যরা ভয় পেয়েছিলেন একটি আসন্ন মন্দা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল করার ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয় সেসব দেশ। অথচ আজকাল কোনো ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ নয় জি-২০-র সদস্যরা।
Advertisement
আরও পড়ুন> জি-২০ সম্মেলন/ভারত সফর করবেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জি-২০ ক্লাব এখন বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক ফল্টলাইনে বিভক্ত। আমেরিকা ও তার কিছু মিত্র চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি তারা ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। ভারতসহ কিছু দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশও চীন নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু যখন ইউক্রেনের কথা আসে, তারা আবার ভারতের সঙ্গে প্রধানত খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং তাদের পাবলিক ফিন্যান্সের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়।
ভারত এ ধরনের ব্যবধান কমানোর জন্য একটি গুরুতর প্রচেষ্টা করবে এমন পরামর্শ দেওয়ার মতো কিছু নেই। ঐক্যমত্য গড়ে তোলার জন্য বাণিজ্য ও সমঝোতার প্রয়োজন যেগুলোর কোনটিই ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির বিশিষ্ট নয়। এমনকি ভারত যখন আমেরিকা এবং তার অনেক ভারতপন্থি মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে, মোদীর সরকার একই দেশগুলোকে ‘ভারত-বিরোধী’ এজেন্ডা ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এনে তার দেশীয় সমর্থকদের সঙ্গে খেলছে।
গত সপ্তাহে একটি সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিয়ে বলেন, ‘মোদীর জন্ম রাজ্য গুজরাটে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি রক্তক্ষয়ী গণহত্যার সময় তার ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে, এটি ছিল বিদেশি শক্তির মাধ্যমে ভারতের ওপর আক্রমণ।’ তিনি বলেন, অন্য উপায়ে ‘যুদ্ধ বলে একটি শব্দবন্ধ আছে।’ এটি অন্য উপায়ে রাজনীতি… আমি জানি না ভারতে নির্বাচনের মৌসুম শুরু হয়েছে কি না, তবে নিশ্চিতভাবেই এটি লন্ডন ও নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে।’
আরও পড়ুন> রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ/ জি-২০ সম্মেলনে মস্কোর প্রতি নিন্দা, চীনের বিরোধিতা
ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের অধীনে জি-২০-র উদ্বোধনী এবং গত সপ্তাহে ভারতের স্টার্টআপ রাজধানী বেঙ্গালুরুতে অর্থমন্ত্রীদের একটি বৈঠকে খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা যুদ্ধ এবং এর অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। জাপানের অর্থমন্ত্রী সুজুকি শুনিচি বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নেওয়া জি-২০ এর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।’
একইভাবে ভারতীয় আরেকিটি এজেন্ডায় অগ্রাধিকার জলবায়ু অর্থায়ন, যা পশ্চিমা দেশগুলোর ইস্যুতে দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিপূরণমূলক অতিরিক্ত চাহিদা জমা করছে। জি-২০-র ভারতের এজেন্ডায় কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে হচ্ছে। এই সম্মেলনে অন্তত দুশোটি বৈঠক হবে। যেখানে ভারতের নীতি হলো এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। একজন নেতা, একজন ভারতীয় পর্যবেক্ষকও যোগ করা যেতে পারে এতে।
সূত্র: দ্য ইকোনিমিস্ট
এসএনআর/এমএস