স্বাস্থ্য

চিকিৎসাব্যয়ে বিশ্বে ৮ম বাংলাদেশ, ওষুধ-ইনসুলিনের দামে নাভিশ্বাস

# খরচ বাড়ায় রোগীরা চিকিৎসা চালাতে হিমশিম# ৩৪ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী ভোগেন বিষণ্নতায় # ৫০ শতাংশ রোগীই জানেন না তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত

Advertisement

দেশে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। আক্রান্তের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। আশঙ্কার বিষয়, কমবয়সীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে রোগটি। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়সের মানুষদের মধ্যে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস চিকিৎসার খরচের দিক থেকেও অষ্টম বাংলাদেশ। সম্প্রতি সব ধরনের ওষুধ, স্ট্রিপ, ইনসুলিনের দাম বাড়ায় নাভিশ্বাস রোগীদের।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) প্রকাশিত সবশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা যায়।

আরও পড়ুন>> প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের রক্ষা করা গেলে সাশ্রয় হবে ১ লাখ কোটি টাকা

Advertisement

আইডিএফ বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখে। এ সংখ্যা ২০৪৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ২০ লাখের মতো। ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতা সমস্যা বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতা উভয়ই ভীষণ উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। মূলত রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান না থাকা, নিয়ন্ত্রণে রাখার পদ্ধতি সম্পর্কে না জানা, আর্থিক দৈন্যদশায় নিয়মিত চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হওয়া এর কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন মাত্রার বিষণ্নতায় আক্রান্ত।

আরও পড়ুন>> ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেয়ে না রাখা আরও ব্যয়বহুল’

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর হেল্থ রিসার্চ অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন’ (বাডাস-সিএইচআরআই)। প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ রিসার্চের অর্থায়নে ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর একটি গবেষণা শুরু করছে। ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের অংশীদারত্বের মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতায় ভোগা রোগীদের জন্য বিহেভিয়ারাল অ্যাক্টিভেশন নামক এক ধরনের থেরাপি নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি।

Advertisement

বাডাস-সিএইচআরআই-এর রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ডা. নাভিদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আচরণগত বিষয় নিয়ে প্রকল্পটি দক্ষিণ এশিয়ায় বিষণ্নতা এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ‘বিহেভিয়ারাল অ্যাক্টিভেশন পদ্ধতির বিকাশ ও মূল্যায়ন’ শিরোনামে পরিচালিত হচ্ছে। যার তত্ত্বাবধায়ন করছেন অধ্যাপক ডা. কিশোয়ার আজাদ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় আচরণগত থেরাপি সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। পশ্চিমা বিশ্বে এটি বিষণ্নতা মোকাবিলায় একটি কার্যকর থেরাপি। বাংলাদেশে এই থেরাপি কার্যকর কি না তা বোঝাই এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন>> নখ দেখেই বুঝে নিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কি না

নতুন এ প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, কর্মসূচিটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়েছে, যা ২০২৪ সালের আগস্টে শেষ হবে। এই প্রক্রিয়ায় বারডেম হাসপাতালে আসা ২১০ জন এবং সিলেট ডায়াবেটিস সমিতির হাসপাতালে আসা ১০০ জন রোগীর তথ্য নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় তথ্য দিতে আগ্রহী রোগীদের দুটি প্রশ্ন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বারডেমে ৪০ জন এবং সিলেটে ২৪ জনের ওপর ট্রায়াল হয়েছে। তাদের মধ্যে বিহেভিয়ারাল অ্যাক্টিভেশন থেরাপি দেওয়া হয়েছে ৩২ জনের।

সরেজমিনে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডায়াবেটিস পরীক্ষার স্ট্রিপ, ইনসুলিন ও মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীপ্রতি খরচ বেড়েছে দুই থেকে চার হাজার টাকা।

গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা মাবিয়া বেগম। প্রথম দুই বছর তার গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হলেও এখন প্রতিমাসে খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো। ডায়াবেটিসের কারণে নানাবিধ শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়েছে তার।

৫০ বছর বয়সী ঢাকার চকবাজারের বাসিন্দা ছাহেরা বেগম জানান, তিন বছর আগে তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তারপর থেকে প্রতি দুই থেকে তিন মাস পরপর বারডেম হাসপাতালে আসেন। সুস্থ থাকতে প্রতি মাসে দুটি করে ইনসুলিন লাগে। এছাড়া শরীরে অতিরিক্ত চর্বি কমানোর ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু এক বছর আগেও যে ইনসুলিনের দাম ৩৭০ টাকা ছিল, এখন তা ৪৫০ টাকা হয়েছে।

আরও পড়ুন>> ডায়াবেটিস কী? এই রোগ সম্পর্কে যা জানা জরুরি

শাহবাগ ও বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে জানা যায়, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার স্ট্রিপ সিনোকেয়ার গত বছর ছিল ৩৭০ টাকা, বর্তমানে ৪০০ টাকা। অ্যাকু চেক অ্যাকটিভ ২৫টির প্যাক আগে ছিল ৮০০ টাকা এখন ১১শ টাকা। হিমুলিন ৬টি ভায়ালের এক প্যাকেটের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। আগে ছিল ২৪০০ টাকা বর্তমানে ২৬০০ টাকা। এছাড়া র‌্যানটাস ১২৯০ টাকার প্যাকেট ১৫০০ টাকা হয়েছে। কমপ্রিড ট্যাবলেট সাত থেকে বেড়ে হয়েছে আট টাকা। ডায়মোরাল ট্যাবলেট ৮ থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে অ্যাটোভা ১০ মি. গ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকা, রসুভা ১০ মি. গ্রাম ট্যাবলেট ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬ টাকা।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান জাগো নিউজকে বলেন, সবকিছুর দাম যখন বাড়ছে, ডায়াবেটিস রোগীদের খরচ বাড়াও স্বাভাবিক। তবে আশার কথা হলো টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিনটা সরকার ফ্রি দেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে সরকার টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদেরও ইনসুলিন ফ্রি করে দেবে। এর সঙ্গে মুখের ওষুধও পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, বিষণ্ন মনোভাব এবং একই সঙ্গে ডায়াবেটিসের মতো শারীরিক সমস্যার সম্মিলিত অবস্থান নিয়ে জীবনযাপন করা সহজ নয়। যেসব ব্যক্তির ডায়াবেটিস ও অন্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এমন অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ও ডায়াবেটিস বা অন্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ উভয়ের অবনতি ঘটে। ফলে আরও শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায়, বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বিষণ্নতার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পর্যাপ্ত নয়। ন্যাশনাল পলিসিতে এটি যুক্ত করা জরুরি।

বারডেম একাডেমির পরিচালক ও অ্যান্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান জাগো নিউজকে বলেন, ডায়াবেটিস রোগী শুরুতে পাঁচ থেকে ছয় বছর চিকিৎসার আওতার বাইরে থাকেন। কারণ, এই সময়ে তাদের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। আমাদের ৫০ শতাংশ মানুষ জানেন না তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। ২০২১ সাল আমরা এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর সার্ভে করি। যারা ডায়াবেটিস নেই বলে জানেন। স্ক্রিনিং করে দেখা যায়, প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে। আমাদের নিজস্ব সার্ভে অনুযায়ী আরও অনেক বেশি মানুষ ডায়েবেটিসে আক্রান্ত।

এএএম/এএসএ/এমএস