২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এই একবছরে আলোচনা, সমালোচনা কোনোটিই পিছু ছাড়েনি। গাইবান্ধা-৫ আসনে উপ-নির্বাচন বন্ধ করা যেমন আলোচনায় এনেছে, তেমনি ইভিএমে ভোট করতে তোড়জোড় সমালোচনায় ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এছাড়া দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে পারেনি কমিশন।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন অবস্থায় আসন্ন সংসদ নির্বাচন তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
তবে কমিশনের বর্ষপূতি উপলক্ষে এক লিখিত প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সবগুলো নির্বাচন সততার সঙ্গে করেছেন। প্রতিটি কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গেই করবেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
অন্যদিকে ইভিএমের সাফাই গেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল আবারও বলেছেন, ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। বিগত ১০ মাসে এ ধরনের কোনো বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগ পাওয়া যায়নি
Advertisement
দিনের ভোট-রাতের ভোট
এই সরকার রাতের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে, বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই করছে এমন দাবি। গত বছরের মে মাসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, কমিশন থেকে আমরা বলবো, ভোট নিয়ম অনুযায়ী হবে। দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না, এটা আমরা স্পষ্ট করে বলছি।
এতে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে, বিগত সংসদ নির্বাচন যে রাতের বেলায় হয়েছে তার এ বক্তব্যেই তা স্পষ্ট।
সংলাপ, বর্জন, সমালোচনা
Advertisement
দায়িত্ব নেওয়ার পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত বছরের ১৭ জুলাই থেকে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানায় ইসি। ২৬টি দল তাতে অংশ নিলেও অনেক দল অংশ নেয়নি। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইসির সংলাপের আহ্বানে সাড়া দেয়নি বিএনপিসহ ৯টি দল।
আবার সংলাপে অধিকাংশ দল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বিপক্ষে মত দিলেও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে আবারও শুরু হয় প্রবল সমালোচনা। কিন্তু সরকার এই খাতে অর্থ বরাদ্দ না করায় সেখান থেকেও পিছিয়ে আসতে হয়। এরপর ৫০ থেকে ৬০টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এই ঘোষণাও এখন বাস্তবায়ন না হওয়ার পথে।
এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসির কাছে থাকা ইভিএম মেশিন। যেসব ইভিএম নষ্ট হয়েছে তা ঠিক করতে হাজার কোটি টাকা লাগবে। আবার ভালো ইভিএমও রক্ষাণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে।
ইসি সূত্র জানায়, নষ্ট ইভিএম ঠিক করার জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) বৈঠক করেছে। বিএমটিএফ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছে, প্রকল্পের যতগুলো ইভিএম আছে তা সংরক্ষণ ও ব্যবহারযোগ্য করার জন্য মেরামতে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লাগবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে দেনা-পাওনা নিয়ে বিএমটিএফের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যেসব ইভিএম আছে সেগুলো সংরক্ষণ ও মেরামত করতে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু কমিশনের কাছে এই মুহূর্তে এত টাকা নেই। কাজটা তাহলে কীভাবে হবে সে বিষয়েও কমিশন এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
নির্বাচন বন্ধ
তবে গত বছরের অক্টোবরে ভোটকেন্দ্রে নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপ-নির্বাচন বন্ধ করে আলোচনায় আসে ইসি। সাম্প্রতিক অতীতে এভাবে কোনো আসনের ভোট সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়ায় তাদের সাধুবাদ জানান অনেকে। বুথে বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে অনিয়মের চিত্র পাওয়ায় এই নজীরবিহীন ঘটনা ঘটায় ইসি। কিন্তু পরে অনুষ্ঠিত এই উপ-নির্বাচনে একযোগে চার প্রার্থী ভোট বর্জন করেন। নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে সেদিন সকালেই তারা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এছাড়া ইভিএমে ভোট গণনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
আরও পড়ুন: কুমিল্লা সিটি: নতুন ইসির ইমেজ তৈরির নির্বাচন
কমিশনের বর্ষপূতিতে লিখিত প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন,কত সময় পার হলো, প্রথম বছর গেল কিংবা শেষ বছর এলো, এটি আমার কাছে মুখ্য নয়। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি, এটা করেই যাবো। প্রতিটি কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গেই করবো।
শপথ নেওয়ার পর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পাঁচ কমিশনার
তিনি বলেন, আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জ নয়, প্রতিটি নির্বাচন যেভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করেছি, একইভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও করবো ইনশাআল্লাহ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও এরই মধ্যে বলেছেন, দেশ-বিদেশে সবার কাছে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
ইসির একবছর কেমন কাটলো সে বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, তাদের মূল পরীক্ষা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তবে এই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলে ইসি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। যদিও সবগুলো দল নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ডা. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ইসির কর্মকাণ্ডে এখনো জনগণ আস্থা আনতে পারেনি। আসলে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। দিনের ভোট যে রাতে হয় তা ক্ষমতাসীন অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও ইসির বক্তব্যে পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং অন্য চার কমিশনার। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী পাঁচ নির্বাচন কমিশনারকে শপথ পাঠ করান। এর পরের দিন থেকে তারা নির্বাচন কমিশন ভবনে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
তার আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান করে গঠন করা হয় নতুন নির্বাচন কমিশন। তার নেতৃত্বে নতুন কমিশনে আরও চার কমিশনারের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান।
তবে শুরুর দিন থেকেই বিএনপি বলে আসছে, নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির কোনো আগ্রহ নেই।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমাদের মূল কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এটা জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে।
এইচএস/এমএইচআর/জেআইএম