একুশে বইমেলা

অমর একুশে বইমেলায় আমাদের প্রত্যাশা

রাসেল আবদুর রহমান

Advertisement

অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য নাম ও আয়োজন। স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম যা আমাদের নিজস্ব জাতীয় ঐতিহ্যে রূপ নিয়ে অবিচল ও অবিকৃতভাবে চলছে। স্বাধীনতা ও যোগ্য নেতৃত্ব যে একটি জাতিকে সমৃদ্ধ করে, তা নতুন করে প্রাসঙ্গিক করা বাহুল্য। তবে বইমেলার কথা বলতে গেলে স্বভাবতই প্রসঙ্গটি চলে আসে। তার অবশ্য কারণও আছে। পৃথিবীর একমাত্র ও বিরলতম ভাষা হলো বাংলা ভাষা। যে ভাষাকে নিজস্ব ও রাষ্ট্রীয় করতে রক্ত ও প্রাণ দিতে হয়েছে। মর্যাদার দিক থেকে এ ভাষা শহীদী ভাষা। এ ভাষার সম্মান অতুলনীয় ও অনন্য। তাই এ ভাষার হরফে মুদ্রিত বইয়ের একটি আলাদা দ্যোতনা আছে। ভিন্ন গুণের ঐতিহ্য বহন করে এ ভাষার বই। বাংলা ভাষায় ছাপানো বই পড়তে শুরু করলে বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে ওঠে। মনটা আর্দ্র হয়ে আসে। কিন্তু গর্বে ফুলে ওঠে বুকের ছাতি। এ আমার ভাইয়ে রক্তে ও প্রাণে কেনা আমার মায়ের ধ্বনি! অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার স্বাক্ষর। মাথা না নোয়ানোর ইতিহাস। গোলাম না হওয়ার প্রেরণা। পরাজিত না হওয়ার বীজ।

অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। স্বাধীন রাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছে এ ঐতিহ্য। প্রথম ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মুক্তধারা পাবলিশিং হাউজের চিত্তরঞ্জন সাহা শুরু করেন। বাঙালির মননে রুয়ে দেন বইমেলার বীজ। ১৯৭৮ সালে জাতীয় চেতনায় আসে তাঁর ফোটানো স্বপ্নকলি। ১৯৮৪ সালে এই স্বপ্নকলির নাম হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। যা আজ জাতির চেতনায় বিকশিত হয়েছে কোটি কোটি পাঁপড়ির ফুলে। যা আমাদের অনন্য ইতিহাস। আলোর বয়ান। গর্বের। আনন্দের।

আরও পড়ুন: বই প্রকাশ কি কমে যাবে?

Advertisement

একসময় বইমেলা হতো শুধু বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণে। তারপর সামনের রাস্তার দুপাশে সম্প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু ওই সম্প্রসারণ আমাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তাই প্রয়োজনে তা এখন বাংলা একাডেমির মূল চত্বরসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বয়স যত বাড়ছে; আমরা ততই সমৃদ্ধ হচ্ছি। বাড়ছে আমাদের জ্ঞানের পিপাসা। বাড়ছে আমাদের পরিধি। সেটির নক্ষত্র প্রমাণ এই বইমেলা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা আমাদের অতিক্রম করছি। উজ্বল দিনের জন্য রোপিত বৃক্ষকে আশা ও প্রত্যাশার ফলে পরিণত করছি। এটি দারুণ আনন্দের।

বইমেলার আয়োজন যদিও এখন আর স্থানভিত্তিক নেই। প্রযুক্তির বিশ্বায়নে সেটি কল্পনা করা মানে অবাস্তব চিন্তায় নিজেকে মশগুল রাখা। ইথারের মানচিত্রে পৃথিবীর আলাদা কোনো দেশভাগ নেই। সবকিছুই এখন সবার নাগালে। রকমারি ডটকম, অথবা ডটকম, বইবাজার, প্রথমা ডটকম, আমাজনসহ নানা অনলাইন আমাদের ‘অমর একুশে বইমেলা’র আয়োজনকে প্রত্যেকের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। সহজ ও স্বাচ্ছন্দময় করছে প্রয়োজনকে। পাল্টে দিয়েছে আনন্দ উপভোগের ধরন। চাইলেই এক ক্লিকে যুক্ত হওয়া যায় বইমেলায়। মেতে ওঠা যায় উল্লসিত আনন্দের স্রোতে। তবুও বইমেলা নিয়ে বাড়ছে আমাদের নতুন নতুন প্রত্যাশা। সময়ের সঙ্গে প্রত্যাশা বাড়াটাই স্বাভাবিক। না বাড়লে সেটি হবে স্বপ্নের অপমৃত্যু।

আরও পড়ুন: বইমেলায় সালাহ উদ্দিন মাহমুদের দশম বই

মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে চাহিদা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জোগানও। জোগান বাড়াটা স্বাভাবিক ও কাম্য। তবে অন্য সব পণ্যের মতো বইকে বিপণন পণ্য মনে করার সুযোগ নেই। সেটি মনে করলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং পথ হারাবে জাতি ও জাতীয় বোধ। কেননা, বই হলো জ্ঞানচর্চার বাহক। বাহক নাজুক হলে তা বিপদের মুখোমুখি হবে; সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বই প্রকাশে সচেতন হতে হবে। বিষয় বা সেক্টর ভিত্তিক বুদ্ধিদৃপ্ত সম্পাদকমণ্ডলী দ্বারা প্রকাশের আগে বই সম্পাদিত হওয়া এখন সময়ের দাবি। আমার এ দাবি প্রকাশনা স্বাধীনতা বিরোধী নয়। স্বাধীনতার মানে তো আর যা ইচ্ছে তা করা নয়। স্বাধীনতা বলতে সুন্দরের উৎকর্ষ বোঝায়। অসুন্দরের ওপর সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করাকে বোঝায়। সমগ্র জাতির কল্যাণমূলক কাজ করাই হলো অর্থবহ স্বাধীনতা। সঠিক উপয়ে রাষ্ট্রে বসবাসকারীদের প্রয়োজনকে মিটানো হলো স্বাধীনতার উদ্দেশ্য।

Advertisement

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এসইউ/জেআইএম