আইন-আদালত

সাজা শেষ হলেও বিস্ফোরক মামলায় ঝুলে আছে অনেকের মুক্তি

একে একে কেটে গেছে ১৪ বছর। এখনো শেষ হয়নি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কোনো মামলার চূড়ান্ত বিচারকাজ। এ ঘটনার দায়ের হওয়া হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে। বিস্ফোরক আইনে করা অন্য মামলার বিচার এখনো চলছে বিচারিক আদালতেই। এরই মধ্যে অনেক আসামির হত্যা মামলায় সাজা ভোগ শেষ হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন থাকায় তারা মুক্তি পাচ্ছেন না।

Advertisement

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কিছু বিপথগামী সদস্য দাবি আদায়ের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায়। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের পাশাপাশি তৎকালীন মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিপথগামী বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরাও। তারা নারী ও শিশুসহ ১৭ জন বেসামরিক নাগরিককেও নির্মমভাবে হত্যা করে।

বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা এটি। মামলাটি এখন আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন জানান, এ বছরই আপিল শুনানি শুরু করতে চান তারা।

আরও পড়ুন: পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৪ বছর: চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনো মামলার

Advertisement

পিলখানায় ভয়াবহ নৃশংসতার পর হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা দুটি মামলার বিচার একসঙ্গে শুরু হয়। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট- দুই জায়গাতেই হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এখন দেশের উচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে একই ঘটনায় নিম্ন আদালতে ঝুলে আছে বিস্ফোরক আইনে করা অপর মামলাটি। যদিও এরই মধ্যে কেটে গেছে ১৪ বছর।

ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ডের এত বছর পরও বিস্ফোরক আইনে করা মামলাটি এখনো বিচারিক (নিম্ন) আদালতের গণ্ডি পেরোয়নি। সাক্ষ্য গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা বিস্ফোরক মামলায় এখন পযন্ত ২৫৭ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ২৭ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এ অবস্থায় মামলাটির কার্যক্রম চলতি বছরেই শেষ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউটর মো. মোশাররফ হোসেন কাজল।

এদিকে, হত্যা ও বিদ্রোহ মামলায় খালাস মিললেও কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না দুই শতাধিক আসামি। এ অবস্থায় মামলার আপিল শুনানির জন্য প্রয়োজনে আবারও বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দুটি মামলার মধ্যে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অথচ অন্যটি এখনো ট্রায়াল পর্যায়ে। খুব সহজেই বোঝা যায় রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। আমরা উভয় মামলা খুব দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছি, করে যাচ্ছি। অনুরোধ করবো, রাষ্ট্রপক্ষ যেন দুটি মামলাই দ্রুত নিষ্পত্তি করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: পিলখানা ট্র্যাজেডি, শতবর্ষী জুলেখা বেগমের স্বপ্ন কি পূরণ হবে?

আলোচিত এ মামলায় বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা হবে কি না- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, নিয়মিত যে আপিল বিভাগ বেঞ্চ আছে, সেখানেই এর বিচার হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা জানান, আলোচিত এ মামলার শুনানি চলতি বছরেই হতে পারে। আপিলের সারসংক্ষেপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে। সেটি চার সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে হতে পারে, এর বেশি কোনোভাবেই হবে না।

এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরাও এই মামলায় আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক মামলার বিচারের দুই ধাপ শেষ হয়েছে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে। রায় কার্যকর করতে হলে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, শেষ ধাপটি চলতি বছরই হতে পারে। হত্যা মামলায় হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত এবং যাদের সাজা কমানো হয়েছে, তাদের সাজা বাড়াতে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিলও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথমে উভয়পক্ষের লিভ টু আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি হবে। তারপর আপিলের শুনানি ও মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।

আরও পড়ুন: দরবার হলে সেদিন যা ঘটেছিল

তবে কিছুদিনের মধ্যেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৩৩টি আপিল দাখিল করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর আপিল শুনানি হতে পারে।

জাগো নিউজকে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আশা করছি এই বছরেই এ মামলার শুনানি করতে পারবো।

তিনি বলেন, পিলখানায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, নৃশংসভাবে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় অনেকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে, সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও আপিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে অনেকের সাজা কমেছে, অনেকের বহাল আছে।

এ এম আমিন উদ্দিন আরও বলেন, হাইকোর্টের রায়ে যাদের সাজা বহাল আছে তাদের মধ্যে ৩৩ জন আপিল বিভাগে আপিল ফাইল করেন। এরপর আসামিপক্ষ মামলার আপিলের সার সংক্ষেপ জমা না দেওয়ায় মামলাটা আমরা শুনানি করতে পারছিলাম না। তাদের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য আমরা একটা ফাইল করেছি। এই ৩৩টা ফাইল আসবে। তাদেরকে একটা সময় দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যদি তারা না দেয় তাহলে তাদের আপিলটা ডিসমিস হবে। আশা করছি এই বছরই এই মামলার শুনানি করতে পারবো।

গত বছরও আপনাদের একই বক্তব্য ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছর আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা জমা দেয়নি। সেই কারণে আমরা আবেদন করেছি। আদালতের কাছে চাইবো তাদের যেন একটা সময় নির্ধারণ করে দেন। ওই সময়ের মধ্যে তারা যদি না দেয় তাহলে তাদের আবেদন ডিসমিস করে দেবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, শুরু হওয়াটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। আদালতের ওপর নির্ভর করে। আর গত বছর না হওয়ার পেছনে কারণ হলো গত বছর এই মামলাটা শুনানির জন্য পর্যাপ্ত বিচারক ছিলেন না। এখন আপিল বিভাগে যেহেতু আটজন বিচারক আছেন, আশা করি (এ বছর) এটার শুনানি হবে।

আরও পড়ুন: স্বজন হারানোর বেদনা আজও কাঁদায়

তিনি বলেন, আমার প্রচেষ্টা আছে বলেই আমি ফাইল নিয়ে গেছি। আমরাও কিছু ফাইল করেছি। অপর্যাপ্ত সাজা দেওয়ার জন্য কিছু ফাইল করেছি। নিয়মিত বেঞ্চে (শুনানি) হবে। কমপক্ষে চারজনের বেঞ্চ হলেও হবে।

‘কেউ কেউ আর্থিক কারণে আপিল করতে পারছে না বিষয়টি এমন নয়। তার কারণ হলো আর্থিক কারণে কেউ আপিল করতে না পারলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী জেলখানায় দরখাস্ত দিলে হয়ে যাবে।’

বিস্ফোরক আইনের মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে হচ্ছে না সেটা না দেখে বলতে পারবো না।

পিলখানা হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়েছে। আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ২০৩ আসামির পক্ষে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করেছেন। এরমধ্যে ৮২ জনের পক্ষে আপিল এবং বাকিদের পক্ষে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। আসামিদের পক্ষে একাধিক আইনজীবী বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল দাখিল করেছেন এবং করছেন বলে জানা গেছে।

আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দাখিল করতে হবে। এ মামলায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায়ের পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) প্রকাশিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে এরপর আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ কারণে উভয়পক্ষের আপিল দাখিল করতে দেরি হয়। তাই প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অন রেকর্ডের মাধ্যমে আপিল দাখিল করা হয়।

প্রথম আপিল দাখিলের ব্যয় ১৮ লাখ টাকা: হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রথম আপিল দাখিল করতে খরচ হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম আপিলটি করা হয়। এটি ছিল ৬৬ হাজার পৃষ্ঠার। বই বাইন্ডিং, রায়ের সার্টিফায়েড কপি, প্রতিটি চারশ পাতার ভলিয়ম তৈরি, প্রতিটি আপিল ১৪টি সেট প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্নিষ্ট শাখায় আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ দাখিল করা হয়েছে। এরপর পেপারবুক ছাড়াই মেমো নম্বর দিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও ৪৭টি আপিল দাখিল করা হয়।

বিস্ফোরক মামলার বিচার: ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে প্রতি মাসে দুইদিন করে বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। চলতি মাসেও এ মামলার সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এ মামলার বিচারকাজ চলতি বছরই শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩৪৫ সাক্ষীর মধ্যে ২৫৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

আরও পড়ুন: পিলখানা হত্যায় ৭১ আপিল, বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যই শেষ হয়নি

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, আসামিরা ১২ বছর ধরে কারাগারে আছেন। অথচ ২৫৬ আসামির ১০ বছর করে সাজার মেয়াদ ছিল। তাদের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন থাকায় তারা মুক্তি পাচ্ছেন না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, প্রয়াত নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেন আদালত।

মামলার মোট আসামি ৮৩৪ জন। এরমধ্যে ২৪ জন মারা গেছে এবং পলাতক রয়েছেন ২০ জন। দুটি মামলার একই আসামি হওয়ায় তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রতি মাসে দুই থেকে তিন দিন মামলার কার্যক্রম চালানো হয়।

২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ডের (ফাঁসি) রায় বহাল রাখেন। ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন হাইকোর্ট। খালাস পান ৪৯ আসামি।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, এ বছর আপিল শুনানি শুরু করবে রাষ্ট্রপক্ষ। তার আশা, চলতি বছরই মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। তিনি আরও জানান, ১৩৯ জনের ফাঁসি বহালের পাশাপাশি যাদের সাজা কমানো হয়েছে, সে বিষয়েও শক্ত অবস্থান নেবে রাষ্ট্রপক্ষ।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা ৩৩টি আবেদন ফাইল করেছি। আবেদন অনুযায়ী কোর্টে আসবে, তাদের সময় দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না হলে আপিলটি বাতিল হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়াগুলো শেষ করে আশা করি এ বছরই মামলাটি শুনানি করতে পারবো।

কী ঘটেছিল সেদিন২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকেন তারা।

বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারান।

মামলা ও বিচারিক আদালতের রায়ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৪৬ বিডিআর জওয়ানকে। আরও চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যান। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তাদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৬১ জনকে। এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এতে করে তাদের ৪০ বছরের সাজা হয়। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন আসামি। নিম্ন আদালতের রায়টি ছিল মোট চার হাজার পৃষ্ঠার।

বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তৎকালীন বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলম। বিডিআরের বাইরে দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তারা হলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলী। যদিও ২০১৫ সালে কারাগারে মারা যান নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত তখন বলেছিলেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। একটি বিদ্রোহ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে যে কারণে এ বিদ্রোহ হয়েছে, তা ছিল অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াই ছিল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ।

হাইকোর্টের রায়বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিতরা আপিল করেন। ৬৯ জনের খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে।

২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ১৮৫ জনকে। আর ২০০ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। এছাড়া ৪৫ জনকে খালাস দেন আদালত। এরপর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হত্যা মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ।

৮২টি আপিল ও ১৩৩টি লিভ টু আপিলরায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল আবেদন করেছে আসামিপক্ষ। খালাসপ্রাপ্ত বা কম দণ্ডিতের সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেও আপিল আবেদন করা হয়েছে।

জানা গেছে, দুই শতাধিক আসামির পক্ষে এ পর্যন্ত ৮২টি আপিল এবং ১০২ জনের লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করা হয়েছে। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, এ রকম প্রায় ১০০ আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ৩১টি লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব মিলিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুইপক্ষ ৮২টি আপিল ও ১৩৩টি লিভ টু আপিল করেছে।

হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মামলার রায় ও পর্যালোচনা মিলিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা রয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি আপিল শুনানির জন্য।

পিলখানার ওই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটির বিচারকাজ ২০১১ সালে শুরু হলেও এখনো ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে। ওই মামলার বিষয়ে জানেন না উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ট্রায়াল কোর্টের মামলা সম্পর্কে অবগত নই।

মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ প্রক্রিয়া যারা বলছেন, তাদেরই আপিল, তারা তো নিজেরাই হাইকোর্টে আপিল পরিচালনা করে আসছেন। আমরা সরকারপক্ষ থেকে আপিল শুনানির জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু ওনারা (আসামিপক্ষ) তো আপিল শুনানির কোনো চেষ্টাই করছেন না। এগুলো সব শর্ট আউট করে প্রস্তুত করা হয়েছে। আমরা আপিলগুলো শুনানির জন্য উপস্থাপন করবো।

জানা গেছে, মামলার এফআইআর, অভিযোগপত্র, সাক্ষীর জবানবন্দী, বিচারিক আদালতের রায়, হাইকোর্টের রায়ের কপি, রায়ের পর্যালোচনাসহ সব মিলিয়ে ৫০ হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠা রয়েছে।

আসামিদের পক্ষে খালাস চেয়ে আপিল আবেদনকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮২ আসামির খালাস চেয়ে আপিল ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পক্ষে লিভ টু আপিল আবেদন করেছি। আপিল আবেদনগুলোর যেন তাড়াতাড়ি শুনানি করা হয়, সে অপেক্ষায় আমরা।

এফএইচ/কেএসআর/এএসএম