আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিতে গত বছর বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে পারেনি সিন্ডিকেট। ফলে দেশীয় লবণের দাম বেড়ে যায়। গত বছরের জমানো লবণ মৌসুমের আগেই বিক্রি হয়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা মণ দরে। দেশি লবণ বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় চাষেও ঝুঁকেছিলেন উপকূলীয় লবণচাষিরা। কিন্তু উপকূলে উৎপাদিত লবণের দাম হঠাৎ পড়ে গেছে। ভরা মৌসুমে লবণ মিলমালিকরা সিন্ডিকেট করে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ থেকে কমিয়ে অর্ধেকে অর্থাৎ ২৫০ টাকায় নামিয়েছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এতে লাভের আশায় লবণ চাষ করা চাষিরা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
Advertisement
কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী মিলিয়ে প্রায় ৩৮ হাজার প্রান্তিক চাষি লবণ উৎপাদনে যুক্ত। আর বিকিকিনি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহনসহ নানাভাবে লবণশিল্পে জড়িত আরও প্রায় এক লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), কক্সবাজারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ও বাঁশখালী উপজেলায় ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। এবারের লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মাসের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৩ মাসে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ছয় লাখ সাড়ে ৭৪ হাজার মেট্রিক টন লবণ। যা গত মৌসুমে এ সময়ের তুলনায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন বেশি। গত বছর এ সময় উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৯১ হাজার ৫৮ টন। তখন প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৩৫০ টাকায়।
আরও পড়ুন- জুনে পরীক্ষামূলক উৎপাদন, ডিসেম্বরে পুরোদমে চালু
Advertisement
বিসিক সূত্র আরও জানায়, এখন কক্সবাজার উপকূলে দৈনিক ১৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগেও মণ প্রতি লবণ বিক্রি হয়েছিল ৪৮০-৫০০ টাকায়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে লবণের দাম অর্ধেকে নেমেছে। এতে চাষিরা হতাশ হচ্ছেন। লোকসানের আশঙ্কায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। কক্সবাজার সদরের কিছু এলাকায় বিক্রি করে মিলছে ২৫০-২৮০ টাকা। এতে লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩৮ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ প্রায় এক লাখ শ্রমজীবী মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তবে লবণ মিলমালিকরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ২৫০ টাকা হলেও তারা (মিলমালিক) কিনছেন ৩৫০-৩৬০ টাকায়। মাঝখানে শতাধিক টাকার মুনাফা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুরে লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা (মিল) আছে ৬৯টি। উপকূলে উৎপাদিত অধিকাংশ লবণ এখানেই বেচাবিক্রি হয়। চলতি মৌসুমে এখানকার ৩৫টি কারখানায় লবণ উঠছে।
Advertisement
কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মকছুদ আহমদ কোম্পানি বলেন, অসাধু মিলমালিক সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র বন্ধ ও দেশীয় লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। সপ্তাহ আগেও মাঠে মণপ্রতি ৫০০ আর মিল পর্যায়ে ৫৭০ টাকা পাওয়া গেছে। বর্তমানে মাঠে ২৬০ টাকা আর মিলে ৩৪০ টাকা। হঠাৎ এমন দরপতন মেনে নেওয়া যায় না। ন্যায্যমূল্য না পেলে লবণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। দেশীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণ শিল্পের বাজার ধ্বংস করতে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি সর্বস্তরের লবণচাষিদের।
গোমাতলীর চাষি রিদুয়ানুল হক (৩২) বলেন, সাতদিন আগেও প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছি ৪৯০-৫০০ টাকায়। এখন সেই লবণ বিক্রি করছি ২৫০ টাকায়। আগামীতে লবণের দাম আরও কমতে পারে। এ শঙ্কায় রয়েছে আমার মতো অগণিত চাষি। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে চাষিদের খরচ পড়ছে ২০০ টাকার বেশি। এখন বিক্রির পর দালাল ও পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তবে কিছু কিছু এলাকায় ২৫০-২৮০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে লবণ।
আরও পড়ুন- একটি অসমাপ্ত প্রেমের সাক্ষী টেকনাফের ‘মাথিনের কূপ’
চৌফলদন্ডী এলাকার লবণচাষি জমির উদ্দিন (৪৫) বলেন, সপ্তাহখানেক আগেও প্রতি মণ লবণ ৪৭০ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু গত বুধবার কিছু লবণ বিক্রি করতে চাইলে দালাল (লবণ ক্রেতা) ২৫০ টাকা দাম দিতে চান। হঠাৎ এত দাম পড়ে যাওয়ার কারণ কী জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, মিলমালিকরা সিন্ডিকেট কারসাজি করেছেন। উপকূলে উৎপাদিত সিংহভাগ লবণ কিনে নেন মিলমালিকরা। তারা সিন্ডিকেট করে এখন ২৫০ টাকার বেশি দামে লবণ কিনতে চাচ্ছেন না।
কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল বায়ুবিদ্যুৎ এলাকার লবণচাষি হামিদুল ইসলাম বলেন, তিন একর জমিতে চাষ শুরুর পর গত তিন মাসে সাড়ে চারশ মণ লবণ বিক্রি করেছি। ডিসেম্বরে প্রতি মণ লবণের দাম পেয়েছি ৫০০ টাকা। গত বুধবার লবণে দাম বলেছে ২৫০ টাকা। ভরা মৌসুমে লবণের মূল্য কমে যাওয়ায় আমাদের মতো চাষিদের মাথায় বাজ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
ইসলামপুর লবণ মিলমালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ বলেন, মাঠ থেকে আনা এক বস্তা (দুই মণ) লবণ আমরা ৭২০ টাকায় কিনছি। মণ প্রতি লবণের দাম পড়ছে ৩৬০ টাকা। কিন্তু চাষিরা পাচ্ছেন ২৫০ টাকায়। মাঝখানে ১১০ টাকার মতো মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে যাচ্ছে। নানা শর্তে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রীম দাদন নিয়ে চাষে নামেন চাষিরা। উৎপাদিত লবণ বিক্রির সময় মণপ্রতি ৪০-৫০ টাকা কমিশন নিয়ে চলে যান। এ ক্ষেত্রে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারিভাবে প্রান্তিক চাষিদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তারা।
আরও পড়ুন- এক বছরে তিন সিংহ ও দুই হাতির মৃত্যু
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, পলিথিন প্রযুক্তিতে এখন ৬৬ হাজার একর জমিতে দৈনিক ১৭ হাজার মেট্রিক টনের বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। চাষিরা মৌসুমের শুরুতে (ডিসেম্বর) মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। জানুয়ারিতে সেই লবণ বিক্রি হয় প্রতি মণ ৫০০ টাকায়। তবে এখন তা আবার কমে প্রতি মণ ২৫০ টাকায় ঠেকেছে। লবণের দাম আবার বাড়বে সে আশায় চাষিরা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঈদগাঁওয়ের উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বলেন, গত বেশ কয়েক বছর লবণের দাম নাজুক অবস্থায় ছিল। উৎপাদন ও বিক্রিতে সঙ্গতি না থাকায় অনেকে বাপ-দাদার পেশা লবণচাষ ছেড়ে দেন। কিন্তু গত বছর আমদানির লবণ না আসায় মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কেজিতে ১০ টাকা পেয়েছিলেন চাষিরা। ডিসেম্বরেও একই দাম থাকায় আবার নতুন করে পেশায় ফিরেছেন অনেকে। এখন আবার দাম কমে যাওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে চাষিদের মাঝে। পোষাবে না হিসাব করে মাঝপথেই অনেকে উৎপাদন বন্ধ রাখার চিন্তা করছেন। লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে লবণ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেকের নেই। তাই মিলমালিকদের কারসাজি বন্ধে এখনই উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বিসিক সূত্র মতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলা জরিপ অনুযায়ী জেলায় প্রান্তিক লবণচাষির সংখ্যা ৩৭ হাজার ২৩১। চাষিদের সহযোগী হিসেবে (লবণশ্রমিক) মাঠে কাজ করেন আরও ৮৭ হাজার মানুষ। গত মৌসুমে ৫৭ হাজার একর জমিতে লবণচাষ হয়েছিল। লবণ উৎপাদন হয় ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন। এ বছর চাষ হচ্ছে ৬৬ হাজার ৩০০ একর জমিতে।
এফএ/জেআইএম