তথ্যপ্রযুক্তি

বায়োডিজিটাল ক্লোনিং আসছে

এখন ডিজিটাল-স্মার্ট যুগ। আধুনিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ডিজিটাল তথ্যের আদান-প্রদানের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে তথ্যের আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশন ও ইন্টারনেট। যার মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে অপটিক্যাল ফাইবার। অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহারের ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে বহুমুখী, ব্যবসায়িক লাভজনক ও ব্যক্তিগতভাবে। এসব যোগাযোগ চ্যানেলগুলোর নিরাপত্তা-বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা জরুরি। কারণ ব্যবহারকারীরা স্বভাবত আশা করেন যে তাদের ট্রান্সমিটেড ডেটা ও তথ্য সত্যিকারভাবে গোপনে এবং নিরাপদে পৌঁছাচ্ছে।

Advertisement

জি, না। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গোপন’ ও ‘নিরাপদ’ শব্দ দুটো নিয়ে টানাটানি চলছে বেশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি তা হারিয়ে যাবে। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির কারণে। হ্যাকিং নামক শব্দের সঙ্গে দেশবাসী পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাকিংয়ের পর থেকে। এই হ্যাকার নামক চোরদের উপদ্রব সব সময় রয়েছে। মুহূর্তে হারিয়ে যায় কম্পিউটারের সব ডেটা। গুলিয়ে দেয় প্রিয়ার ডিজিটাল মুখ। বর্তমান এই দুঃসময়ে তাই এমন একটা মাধ্যম দরকার, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও গোপনীয়। যেখানে কোনো মেসেজ-ডেটা কাটাছাঁটা বা ঘঁষামাজা হবে না। পৌঁছাবে সময় ও জায়গামাফিক। এমন অনন্য নিরাপদ পদ্ধতির জন্য যে সিস্টেম কাজ করতে পারে, পদার্থবিদ্যার ভাষায় তার নাম ক্রিপটোগ্রাফি। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন বা বায়োডিজিটাল ক্লোনিং।

টেলিপোর্টেশন শব্দের উৎপত্তি টেলিকমিউনিকেশন ও ট্র্যান্সপোর্টেশন শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে। কাল্পনিক সায়েন্স ফিকশনে যার অর্থ হলো কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে কোনো জায়গা থেকে তরঙ্গে পাঠালে গ্রহণ যন্ত্রে তার স্বকল্প তৈরি হয়। অবিকৃতভাবে শূন্য সময়ে ও শূন্য দূরত্বে কাজটা সম্পন্ন হয়। অনেকটা অ্যানিমেশন, সায়েন্স ফিকশন মুভি বা কার্টুনের মতো। দেখামাত্র মিলিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্র আবার অবিকল স্বশরীরে উপস্থিত হয়। এসব দেখে এতদিন ডিজিটাল তরুণ প্রজন্ম আনন্দ পেতো। টেলিপোর্টেশন প্রযুক্তির এই অসম শব্দের উৎপত্তি অসময়ে যেমন নির্মাতাদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে, গতি জুগিয়েছে আরও বেশি কল্পনা করতে। তেমনি এসব গল্প মনের খোরাক জুগিয়েছে কল্পনাবিলাসীদের। সায়েন্স ফিকশনের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে ঘুমিয়ে গেলেও ডিজিটাল প্রজন্মের শিক্ষার্থী, গবেষকরা স্বপ্নে খুঁজে ফিরেছে অলীক বাস্তবতা। প্রযুক্তিগত লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সময়ের তালে-তালে চলতে চলতে ভেবেছে এই অসাধ্য সাধন বাস্তব জীবনে কীভাবে সম্ভব হবে! অদ্ভুত ব্যাপার! ডিজিটাল প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় উন্নতিতে আজ সেই অসম শব্দ বাস্তবের মুখ দেখতে বসেছে। অথচ একদিন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নিজেই একে ‘স্পোকি’ বা গাঁজাখুরী তত্ত্ব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: আকাশে কত তারা? 

Advertisement

কারণও আছে। নিউটনিয়ান ফিজিক্স অনুসারে টেলিপোর্টেশন অসম্ভব। নিউটনিয়ান ফিজিক্স আমাদের বলে অ্যাটম হলো ক্ষুদ্র বিলিয়ার্ড বলের মতো। এটি বলপ্রয়োগ করা ব্যতীত স্থান পরিবর্তন করে না। এটি আকস্মিক দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান দুটো হতে পারে না! স্টারট্র্যাক মুভি সিরিজের মতো কোনো মানুষের শরীরের অ্যাটম আকস্মিক বাষ্প হয়ে অন্য কোনো স্পেসশিপে দৃশ্যমান হতে পারে না। আড়াইশ বছরের নিউটনিয়ান ম্যাকানিজমের আধিপত্যের পর ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ এবং তাদের সহকর্মীরা নতুন একটি থিউরি উন্নত করেন। পদার্থ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, ইলেক্ট্রন তরঙ্গের মতো আচরণ করে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম লিপের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানী গবেষকরা এবার এক বাক্যে স্বীকার করেন, ডিজিটাল কোয়ান্টাম থিউরি- ‘পার্টিকেলরা এটা করতে পারে’।

কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন মেশিন অনেকটা ফ্যাক্স মেশিনের মতো। নাম টেলিপোর্টার। ফ্যাক্সে কোনো খবর পাঠালে অনেক সময় বিকৃত প্রিন্ট হয়ে যায়। ঠিকভাবে বোঝা যায় না। আমাদের দেশে কমার্শিয়াল ফ্যাক্সের নকল কালিতে বলতে গেলে অর্ধেকের বেশি পড়া কষ্টসাধ্য। যেমন- রোকনকে ফ্যাক্স করলে বোঝা যায় না, এটি কার ফ্যাক্স। কারণ ‘র’-এর ফোটা না থাকায় পড়তে হয় বোকন অর্থাৎ গাভি! এর সমান্তরালে আরেক মাধ্যম হলো টেলিবার্তা- স্বজনের বিপদে বা দুর্ঘটনায় খবর পৌঁছে দেয় কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগেও ভাবার্থ ছাড়া অন্য কিছু বোঝা যেত না। এসব প্রযুক্তির আপডেট হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। থ্রিডি থেকে টুয়েলভ্ডি প্রিন্টিং নিয়েও আজ আর কোনো সমস্যা নেই। সব শেষে এবার সত্যি সত্যি আসছে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। যাতে তৈরি হয় পাঠানো শব্দের রেপলিকা। উচ্চ বিমের মাধ্যমে হাজারো কিলোমিটার পর্যন্ত কোন তত্ত্ব বা ডেটা অবিকল প্রেরণ করা সম্ভব।

ক্ল্যাসিক্যাল ফ্যাক্সে স্ক্যান করা বার্তা অনেকটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কিন্ত কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে অরিজিন্যাল ও পাঠানো তথ্য হুবহু হয়। কোনো রকম বিকৃত হয় না। প্রথমে কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে অন্তঃসারশূন্য করা হয় এবং পাঠানো হয় উচ্চ বিমের সাহায্যে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক মাধ্যমে। আর সঙ্গে সঙ্গেই অন্যত্র তৈরি হয় পাঠানো ডিজিটাল বস্তুর ক্লোন। যাকে বলা হয় রেপ্লিকা। এই মাধ্যমে শুধু খবর বা লেখাই পাঠানো যায় তা কিন্তু নয়। থ্রিডি থেকে সব মাত্রার ভিডিও পাঠানো যায় অবিকৃতভাবে। পাঠানো তথ্যের নমুনায় লক্ষ্য করা যায় ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গের মতো চলমান। এই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কাজ করছে কোয়ান্টাম কোড এনট্যাংগ্লমেন্টের সাহায্যে। এনট্যাংগ্লমেন্ট দুটো বস্তুকে একই সময়ে ও অবস্থানে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। তা একে অন্য থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন। এই এনট্যাংগ্লমেন্ট হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্রকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের নতুন চ্যালেঞ্জ স্মার্ট বাংলাদেশ 

Advertisement

একটা সময় মনে করা হতো টেলিপোর্টেশন অসম্ভব। দুটো পার্টিকেলের মধ্যে ইনফরমেশন সেন্ড করা সম্ভব নয়। চার্লস ব্যানেট দেখিয়েছেন ফিজিক্যালি টেলিপোর্টেশন সম্ভব। কিন্ত এতদিন মেক্রোস্কোপিক কোন অবজেক্টের টেলিপোর্টেশন সম্ভব হয়নি। নিউটনিয়ান ফিজিক্সে অসম্ভব হলেও কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে ‘নিলস বোর ইনস্টিটিউট ইন কোপেনহেগেন’ এবং ‘ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব জার্মানি’র দুজন বিজ্ঞানী লাইট বিমকে সিজিয়াম অ্যাটমের গ্যাসের সঙ্গে এনট্যাংগ্লমেন্ট করতে সক্ষম হন। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অ্যাটমের ওপর প্রযুক্ত এ কৌশল তারা লেজার পালসের ভেতর ইনফরমেশন এনকোড করে এবং সিজিয়াম অ্যাটমের ইনফরমেশনকে অর্ধগজ দূরত্বের মধ্যে টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হন।

বিজ্ঞান তত্ত্বমতে আমরা জানি, ইলেক্ট্রন একইসঙ্গে বিভিন্ন প্লেসে অবস্থান করে। যেটি কেমিস্ট্রির মূল বেসিস। আমরা আরও জানি, ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে আবর্তিত হয় সোলার সিস্টেমের ক্ষুদ্র প্রতিরূপের মতো। কিন্তু সোলার সিস্টেম যদি কোলাইড করে তবে তারা একে অপরের থেকে ছিটকে দূরে সরে যাবে। আমাদের গ্রহ গভীর স্পেসে হারিয়ে যাবে! কিন্তু যখন অ্যাটম কোলাইড করে তারা মাঝে মাঝে এমনকিছু মলিকিউল তৈরি করে, যা পুরোপুরি স্টাবল বা অনড়। এবং একে অপরের সঙ্গে ইলেক্ট্রনও শেয়ার করে। আপনি যদি অন্য কোনো স্টার সিস্টেমে যেতে চান, তবে এ মেশিন আপনাকে প্রবাবিলিটি ওয়েভে পরিণত করবে এবং আপনি আবার রিম্যাটারিয়ালাইজ হবেন। সাধারণত কোয়ান্টাম জাম্প অ্যাটমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অ্যাটমের সমন্বয়ে গঠিত বড় অবজেক্টগুলোর জন্য এটিকে জেনারেলাইজড করা যায় না। গবেষকদের প্রশ্ন, কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে যদি অরিজিনাল মানুষকে টেলিপোর্ট করা যায়, তাহলে আগামী দিন কেমন হবে? আগেই বলা হয়েছে, কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে যেহেতু রেপ্লিকা (ডুপ্লিকেট) তৈরি হয়, সেহেতু মানুষের ডুপ্লিকেটও সম্ভব! বিজ্ঞান যাকে বলে বায়োডিজিটাল ক্লোনিং। উচ্চ বিমের মাধ্যমে মানুষকে টেলিপোর্ট করলে যে ডুপ্লিকেট তৈরি হবে, তা হবে মন-মননে জীবন্ত এবং গুণাগুণ হবে শতভাগ আগের মতোই।

জি, হ্যাঁ। কল্পনায় যখন এসব কথা ভাবছেন, ততক্ষণে বিজ্ঞানীরা অনেক দূর পরীক্ষামূলকভাবে এগিয়ে গেছেন। ছবি, ভিডিওতে মানুষ টেলিপোর্ট করার আগের ও পরের নানারকম দৃশ্য ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমে হরহামেশাই দেখা মেলে। তবে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালে ইতোমধ্যে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা কাজে মানুষের ডুপ্লিকেট বায়োডিজিটাল ক্লোনিংয়ের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনে কোনো মানুষকে সূক্ষ্মভাবে টেলিপোর্ট করতে হলে এমন মেশিন তৈরি করতে হবে, যা হবে পিনপয়েন্ট এবং ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন অণু-পরমাণু পর্যালোচনা করতে পারবে। তবেই কেবল মুহূর্তে এবং চূড়ান্তভাবে তৈরি হবে মানুষের ডুপ্লিকেট- বায়োডিজিটাল ক্লোনিং।

আরও পড়ুন: রড নিয়ে যত ভুল ধারণা 

আগামী দিনে ঠিকঠাক সত্যিকারভাবে যদি কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন, বায়োডিজিটাল ক্লোনিং করে মানুষ টেলিপোর্ট করা যায়, তবে কিছু মজার ঘটনা ঘটবে। মানুষকে আপডেট করতে হবে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে। ভবিষ্যতে অবাক করা যেসব ঘটনা ঘটবে তা হলো, যাতায়াতের কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হবে না। বর্তমানের সব যানবাহন অদরকারী হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে দুর্ঘটনামুক্ত! ডেটা-তথ্য পাঠানোর নিরাপত্তা শতভাগ বাড়বে। মৃত্যুহার হবে শূন্যের কোটায়! যদি কেউ আঁচ করতে পারেন যে, তার মৃত্যু আসন্ন; তখন দ্রুত উচ্চ বিমে ডুপ্লিকেট তৈরি করে নিলেই হয়ে যাবে বায়োডিজিটাল ক্লোনিং। নিজেই নিজের মেসেজ-ডেটা পাঠাতে পারবে বায়োডিজিটাল ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে। যা উচ্চ বিম আলোর বেগে চলে বলে মুহূর্তে যে কোনো জায়গায় যেতে পারবে। অনেকটা বিকেলে হাঁটতে বেরোনোর মতো মুহূর্তে যে কোনো গ্রহ-উপগ্রহ প্রদক্ষিণ করা যাবে। রাষ্ট্র, দেশ, মহাদেশ, গ্রহ-উপগ্রহ বলে আলাদা কোন ভেদাভেদ থাকবে না। বিশ্ব ব্যবস্থায় একক কোনো দেশের আধিপত্য থাকবে না। মাল্টি পোলার বা বহু মেরুর পৃথিবী বলয়ের একমাত্র এবং সার্বজনীন নাম হবে সৌরজগত।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/জিকেএস