আজ শুক্রবার। জুমার দিন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি, ১১ ফাল্গুন ১৪২৯ বাংলা, ০৩ শাবান ১৪৪৪ হিজরি। শাবান মাসের প্রথম জুমা আজ। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- আল্লাহর রাস্তায় দানের নিয়ত ও নিয়ম। আল্লাহ তাআলা কোরআন-সুন্নায় দানের অনেক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা কী?
Advertisement
সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। যার পরে আর কোনো নবি নেই। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে দানের নির্দশ দিয়ে বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَ مِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ
হে মুমিনগণ! তোমরা যা কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৭)
Advertisement
প্রিয় মুসল্লিগণ!
আল্লাহ তাআলার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল দান করা। কোরআন-সুন্নায় এর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। ইসলামের অপরাপর আমলগুলোর মতো দান করার জন্যও রয়েছে অনন্য সাধারণ কিছু নির্দেশনা ও নীতিমালা। দানের ক্ষেত্রে যদি সেগুলো রক্ষা করা হয় তাহলে এর যথাযথ প্রতিদান পাওয়া যাবে। এসব দান বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়ে পরকালে নিজের সামনে উপস্থিত হবে ইনশাআল্লাহ। কাজেই দান করার এ নির্দেশনাগুলো সবার জানা দরকার।
১. নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া
বিশুদ্ধ নিয়তবিহীন কোনো আমলই আল্লাহর কাছে মূল্য নেই। আল্লাহর কাছে সেই আমলের কোনো ধর্তব্য হয় না, যেই আমলের সঠিক নিয়ত না হয়। ফলে বিশুদ্ধ নিয়তবিহীন আমলগুলোর সওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যায় না। সব আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।হাদিসে পাকে এসেছে-
Advertisement
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পাবে, যার নিয়ত সে করবে।’ (বুখারি ১; মুসলিম ১৯০৭)
দান করার ব্যাপারেও একই কথা। দান করতে হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তবেই এই দান পরকালে কয়েকগুণ বেড়ে দাতার হাতে ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-
وَ مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللهِ وَ تَثْبِیْتًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍۭ بِرَبْوَةٍ اَصَابَهَا وَابِلٌ فَاٰتَتْ اُكُلَهَا ضِعْفَیْنِ فَاِنْ لَّمْ یُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ
‘আর যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্বতা আনয়নের জন্য, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন কোনও টিলার উপর একটি বাগান রয়েছে, তার উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল, ফলে তা দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। আর তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৫)
প্রিয় মুসল্লিগণ! কিন্তু নিয়ত যদি সহীহ ও শুদ্ধ না হয় তখন দানের ফলাফল হিতে বিপরীতও হয়ে যেতে পারে। হাদিসে পাকে এসেছে, কেয়ামতের দিন সম্পদশালী ব্যক্তিকে আল্লাহর সামনে হাজির করে আল্লাহ তাকে যেসব নেয়ামতরাজি দান করেছেন, তার সামনে পেশ করা হবে। সে দেখে তা চিনে ফেলবে (হাঁ, এসব নেয়ামত তো দুনিয়াতে আমার কাছে ছিল!) তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এগুলোতে তুমি কী আমল করেছ? তখন সে বলবে-
مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ
যেসব খাতে দান করা আপনি পছন্দ করেন এমন প্রতিটি খাতেই আমি আপনার জন্য খরচ করেছি। তাকে ডেকে বলা হবে-
كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ، لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ، فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ
তুমি মিথ্যা বলেছ! তুমি খরচ করেছ- যাতে তোমাকে দানবীর বলা হয়। তা বলা হয়ে গেছে। এরপর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তাকে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম ১৯০৫)
প্রিয় মুসল্লিগণ! কথা একটাই, অল্প হোক আর বেশি, আল্লাহর জন্য দান করব। নিয়ত শুদ্ধ করে সামান্য দানও যদি করতে পারি, সেটি মৃত্যুর পরে কাজে আসবে এবং পরকালে আমার আমলনামায় পাওয়া যাবে। এমনকি যদি নিজের হালাল উপার্জন থেকে স্ত্রী ও পরিবারের জন্য খরচ করা হয় তাও বিফলে যাবে না। তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা সদকার সওয়াব দান করবেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ، إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى اللُّقْمَة تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা-ই তুমি খরচ করবে, তার প্রতিদান দেওয়া হবে; এমনকি স্ত্রীর মুখে তুমি যে খাবারের লোকমা তুলে দাও!’ (মুসলিম ১৬২৮)
নিয়তের ভুলের কারণে নিজের মহামূল্যবান আমলটি যেমন বিনষ্ট হয়ে যায়, তেমনি একান্ত ব্যক্তিগত প্রাত্যহিক কাজও নেক আমলে পরিণত হয় এই বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে।
২. হালাল সম্পদ থেকে দান করা
হালাল সম্পদ থেকে দান করতে হয়। অন্যথা এই দান কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَ مِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ
হে মুমিনগণ! তোমরা যা কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৭)
মুমিন যদি ইখলাসের সাথে হালাল সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে, আল্লাহ নিজ দায়িত্বে সেটিকে যত্ন করে গড়ে তোলেন, বড় করেন এবং কেয়ামতের দিন বান্দার হাতে তা বহু গুণে বৃদ্ধি করে তুলে দেবেন। শর্ত একটাই- ‘হালাল সম্পদ’ থেকে খরচ করতে হবে।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ، كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوّهُ، حَتّى تَكُونَ مِثْلَ الجَبَلِ.
যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করে, আর আল্লাহ ‘হালাল’ ছাড়া গ্রহণ করেন না- আল্লাহ তা ডান হস্তে গ্রহণ করেন। এরপর তা লালন-পালন করে বড় করতে থাকেন। যেমন তোমরা ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন কর। একপর্যায়ে এই ‘সামান্য দান’ পাহাড়সম হয়ে যায়।’ (বুখারি ১৪১০; মুসলিম ১০১৪)
৩. পছন্দের জিনিস থেকে দান করা
মানুষ যা দান করে তা মূলত পরকালের জন্যই আল্লাহর কাছে জমা রাখে। এ জন্য আল্লাহর রাস্তায় দান করার সময় পছন্দের উত্তম জিনিস দান করা উচিত। মানুষ বীজের জন্য ভালো ফসলটাই রেখে দেয়, যাতে নতুন করে বীজ বোনা যায়। কাজেই মুমিন মাসলমানেরও উচিত, হাতে থাকা সম্পদ থেকে উত্তমটাই আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রাখা। নিজের পছন্দের জিনিসটি আল্লাহর পথে খরচ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰی تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ
তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লার জন্য) ব্যয় করবে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯২)
৪. অল্প হলেও সাধ্য অনুযায়ী দান করা
কারো মনে এ ভুল ধারণা জন্মাতে পারে, বা হতাশার উদ্রেক হতে পারে যে, দান করার সাধ্য কি আমার আছে? আমি স্বল্প আয়ের মানুষ; আমি দান করব কীভাবে! না, হতাশার কোনো কারণ নেই! আল্লাহর রাস্তায় দান করার জন্য বিশাল সম্পত্তি লাগে না। ইসলামের শিক্ষা হল, যার হাতে যতটুকু রয়েছে, সাধ্যের ভিতর তা থেকে দান করা। ইখলাসের সঙ্গে হালাল রিজিক থেকে দান করলে ‘সামান্য অর্থ’ও আল্লাহ গ্রহণ করবেন, এর বিনিময়ে দান করবেন পাহাড়সম নেকি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি। তাই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য এক টুকরো খেজুর হলেও দান করতে বলেছেন। হাদিসে এসেছে-
اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ.
‘জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করো, খেজুরের এক টুকরো (পরিমাণ সদকা করে) হলেও।’ (বুখারি ১৪১৭; মুসলিম ১০১৬)
৫. কল্যাণ ও ন্যায়ের পথে দান করা
প্রিয় মুসল্লিগণ! দান তো করবেন, কিন্তু কোথায় দান করবেন? হ্যাঁ, কোন খাতে দান করতে হয় এমন খাতের দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। যেখানে দান করলে অর্থটা কোনো ভালো কাজে খরচ হয়। যার মাধ্যমে দ্বীন-শরিয়ত, ঈমান-আমল বা কোনো দ্বীনী বা মানবিক প্রয়োজন পূরণ হয়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেন-
تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی.
‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা কর।’ (সুরা মায়িদা : আয়াত ২)
তাই দান করতে হবে- গরীব-দুঃখী, বিধবা-অসহায়, এতিম-মিসকিন, মসজিদ-মাদরাসা, ওয়াজ-মাহফিল বা অন্য যে কোনো দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দাওয়াতী কার্যক্রমে। তবেই আল্লাহ দানের প্রতিদান দ্বিগুণ করে ফেরতদেবেন।
পক্ষান্তরে দ্বীনের পথে দান না করে যদি গাঁটের পয়সা খরচ করে নাচ-গান, ওরস-আড্ডা, খেল-তামাশা ইত্যাদিতে খরচ করা হয় তবে এই খরচ নিজের কল্যাণ তো দূরের কথা, ডেকে আনবে অনেক ক্ষতি ও দুর্গতি। তাইতো আল্লাহ নিষেধ করেছেন-
وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ
আর তোমরা গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। (সুরা মায়িদা : আয়াত ২)
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইবনে হাজার হাইতামি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
‘এমনকি কোনো সগিরা গোনাহের পথেও যদি এক টাকা খরচ করা হয়, সেটিও কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।’ (আয্যাওয়াজির আন ইক্তিরাফিল কাবাইর ১/৪২১)
৬. ভারসাম্য রক্ষা করে দান করা
ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ না করে সব নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি নিজের সকল অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে পরের দিন নিজেকেই হাত পাততে হচ্ছে বা পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে কষ্ট হচ্ছে- এমনটি ইসলাম পছন্দ করে না। তাই দানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যার কারণে তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে।’ (সুরা বনি-ইসরাইল : আয়াত ২৯)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় ও জান্নাতী বান্দাদের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে-
وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَنْفَقُوْا لَمْ یُسْرِفُوْا وَ لَمْ یَقْتُرُوْا وَ كَانَ بَیْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا
‘আর ব্যয় করার সময় যারা না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ৫৭)
সম্পদ ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন মুমিন কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে, সেই নীতি সুস্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বললেন-
إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ، وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى اللُّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ
‘তুমি তোমার সন্তান-সন্ততিকে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাবে আর তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এরচেয়ে অনেক উত্তম হচ্ছে তাদেরকে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া। আর তুমি যে খরচই কর না কেন, তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তোমাকে সওয়াব দান করবেন। এমনকি একটি লোকমা, যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও।’ (বুখারি ৪৪০৯)
৭. গোপনে দান করা
এমনভাবে চুপে চুপে দান করা, যাতে কোনো ধরনের আত্মমুগ্ধতা বা আত্মপ্রচারের শিকার হতে না হয়। ডান হাত দান করবে তো বামহাতও যেন টের না পায়। হাদিসে পাকে এসেছে, সাত ধরনের ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। তার মধ্যে অন্যতম হল-
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ
‘যে এমনভাবে দান করে যে, ডান হাতে দান করলে বাম হাতও টের পায় না।’ (বুখারি ১৪২৩)
তবে হ্যাঁ, কখনও গোপনে দান করার চেয়ে প্রকাশ্যে দানের মধ্যেও অনেক কল্যাণ নিহিত থাকে। যেমন দানের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। এটাও যে দানের একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেদিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ইত্যাদি। প্রকাশ্যে দান করা মানেই মন্দ নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنْ تُبْدُوا الصَّدَقٰتِ فَنِعِمَّا هِیَ وَ اِنْ تُخْفُوْهَا وَ تُؤْتُوْهَا الْفُقَرَآءَ فَهُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ
‘তোমরা দান-সদকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতই না শ্রেয়! (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭১)
৮. প্রকৃত হকদারকে দান করা
নিজ দায়িত্বে অভাবীদেরকে খুঁজে বের করে দান করতে হয়। কারণ কিছু মানুষ আছে, যারা অর্থসংকটের শিকার, কিন্তু ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও সামাজিক অবস্থানের কারণে চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে চায় না। মুখ খুলেও কিছু বলতে পারে না বা বলে না। দান করার সময় খুঁজে খুঁজে এমন লোকদেরকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কোরআনে কারিমে কত চমৎকারভাবে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে-
یَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِیْمٰىهُمْ لَا یَسْـَٔلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًا
‘তারা যেহেতু অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারো কাছে সওয়াল করে (চায়) না, তাই অনবগত লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তোমরা তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে (অর্থাৎ তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা) চিনতে পারবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৩)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَيْسَ المِسْكِينُ الَّذِي يَطُوفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ، وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَلَكِنِ المِسْكِينُ الَّذِي لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ، فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلاَ يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ
এক-দুই লোকমা খাবার বা এক-দুইটি খেজুরের জন্য যে মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেয়- অভাবী তো সে নয়; প্রকৃত অভাবী হল, যার অভাব আছে, কিন্তু তাকে দেখে তার অভাব আঁচ করা যায় না; যার ভিত্তিতে মানুষ তাকে দান করবে। আবার চক্ষুলজ্জায় সে মানুষের দুয়ারে হাতও পাততে পারে না।’ (বুখারি ১৪৭৯; মুসলিম ১০৩৯)
৯. নিকটবর্তীদের দান করা
দানের আরেকটি নিয়ম হলো- আগে নিজের নিকটাত্মীয়দের দান করা। এতে একদিকে যেমন সদাকার সওয়াব পাওয়া যায়, একইসাথে আত্মীয়তার হকও আদায় হয়ে যায়। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকটাত্মীয়দের দান করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং একে দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়ার মাধ্যম বলেছেন। তিনি বলেছেন-
الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
‘মিসকিনকে দান করলে কেবল দান করার সওয়াব পাওয়া যায়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব পাওয়া যায়। একটি- দান করার সওয়াব এবং দ্বিতীয়টি- আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।’ (তিরমিজি ৬৫৮)
তবে বিষয়টি যেন এমন না হয় যে, সবসময় অন্য সব গরীব-দুঃখীদের এড়িয়ে কেবল নিকটাত্মীয়দের দান করতে থাকা। কখনও হতে পারে নিকটাত্মীয়ের চেয়েও অন্যদের অভাব ও প্রয়োজনটা বেশি। দান করার সময় তাদের প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত।
১০. খোঁটা বা অন্য কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে দান-অনুদান নষ্ট করে দিব না
দান করে খোঁটা দিতে নেই। অন্যথা সেটি পরকালে দানকারীর জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। বানে ভেসে যাওয়া খড়-কুটোর মতো তা হারিয়ে যাবে। এক কথায় ওই দানের মাধ্যমে সওয়াবের কোনো আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ فَمَثَلُهٗ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَیْهِ تُرَابٌ فَاَصَابَهٗ وَابِلٌ فَتَرَكَهٗ صَلْدًا لَا یَقْدِرُوْنَ عَلٰی شَیْءٍ مِّمَّا كَسَبُوْا
হে মুমিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এরকম- যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৪)
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, খোঁটা দেওয়া দ্বারা নিজের দান-সদকা বা পরোপকারের সওয়াবই নষ্ট হয় না বরং এটি কঠিন পাপও বটে। খোঁটা দ্বারা উপকৃত ব্যক্তির অন্তরে আঘাত দেওয়া হয়। হাদিসে প্রকৃত মুসলিম বলা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে, ‘যার হাত ও মুখ থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ কাজেই দান করে খোঁটা দেওয়ার মত বোকামি কখনও করা যাবে না।
১১. স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করা
‘সদকায় বলা দূর।’ হাদিসে পাকে এসেছে, নিশ্চয়ই সদাকা আল্লাহর ক্রোধকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তাই বলে কি কেবল বিপদে যখন পড়ব তখনই দান-সদকা করব?
না, ইসলামের শিক্ষা হল, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সবসময় সর্বাবস্থায় দান কর। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন-
الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ
‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল (সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে...।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৩৪)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক লোক এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো, কখন দান করা উত্তম? তিনি ইরশাদ করলেন-
أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ شَحِيحٌ، أَوْ صَحِيحٌ، تَأْمُلُ الْعَيْشَ، وَتَخْشَى الْفَقْرَ، وَلَا تُمْهِلْ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بِالْحُلْقُومِ، قُلْتَ: لِفُلَانٍ كَذَا، وَلِفُلَانٍ كَذَا، وَقَدْ كَانَ
‘যখন তুমি (অতি প্রয়োজন বা লোভের কারণে) মাত্রাতিরিক্ত মিতব্যয়ী বা হাড়কিপটে হও এবং সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা কর, অথবা যখন তুমি সুস্থাবস্থায় দীর্ঘায়ুর প্রত্যাশা কর তখন সদকা করা। এত দেরি করো না যে, মৃত্যু এসে যায় আর তখন তুমি (ওসিয়ত করে) বলছ- আমার সম্পদগুলো অমুকের জন্য, অমুকের জন্য! অথচ (তুমি না বললেও) তা তাদের জন্য হয়েই আছে।’ (ইবনে মাজাহ ২৭০৬)
১২. নিজ প্রয়োজনে দান করা
ইসলামের দৃষ্টিতে নিজের প্রয়োজনে দান করতে হয়। দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রতি অনুগ্রহ করা হচ্ছে- বিষয়টি কখনও এমন নয় বরং তার প্রাপ্য ও অধিকারটাই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَ الَّذِیْنَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُوْمٌ لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ
‘আর যাদের সম্পদে নির্ধারিত ‘হক’ (অধিকার) রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।’ (সুরা মাআরিজ : আয়াত ২৪-২৫)
কোরআনুল কারিমে একে তাদের (অসহায়/গবির-মিসকিনদের) ‘হক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং দানকারীর মানসিকতা থাকবে, দান করছি নিজের প্রয়োজনে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইখলাসের সঙ্গে সঠিক পন্থায় দান করার তাওফিক দিন এবং দুনিয়ার দান-সাদকাকে আখেরাতে নাজাতের ওসিলা বানিয়ে দিন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম