শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর এখন যেন ধোঁয়া আর ধুলার নগরী। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা আর বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে গত কয়েক বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে কয়েকগুণ। দূষণের শিকার হয়ে নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন নগরবাসী।
Advertisement
কিন্তু দূষণরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। নামমাত্র পানি ছিটিয়ে রাস্তার ধুলা দূর করার চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
আরও পড়ুন- ২০২২ সালে দুর্ঘটনায় ২২৯ মৃত্যু, বেশি মোটরসাইকেলে
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী তুরাগ সেতু থেকে শুরু করে চেরাগআলী পর্যন্ত ধুলাবালি আর ময়লা আবর্জনায় সয়লাব। একই অবস্থা ভোগড়া বাইপাস থেকে কালীগঞ্জ উপজেলার উলুখোলা পর্যন্ত। গাজীপুর শহর ও আশপাশের কোথাও ধুলাবালির হাত থেকে রেহাই মেলে না। দূষিত বাতাসের কারণে এখন প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গাজীপুরের বাসিন্দাদের।
Advertisement
গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ২১২ মাইক্রোগ্রাম। বায়ুতে এই পরিমাণ ধুলা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
জেলার টঙ্গী ও ধীরাশ্রম এলাকায় হাই ভলিউম এয়ার স্যাম্পলার মেশিন বসিয়ে প্রতিদিন বাতাসে ধুলিকণা পর্যবেক্ষণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এবারের শীত মৌসুমে গাজীপুরে বাতাসে ভারী ধুলিকণার পরিমাণ বাড়তে থাকায় দূষিত বায়ুর জেলা হিসেবে তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে গাজীপুর। সর্বশেষ সুইচ বায়ুমাণ পর্যবেক্ষক সংস্থা আইকিউএয়ারের শহরভিত্তিক এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) সবচেয়ে বাজে দশা ছিল ঢাকার বাতাসের। আর জেলার মধ্যে গাজীপুর। সেদিন গাজীপুরে বায়ুর স্কোর ছিল ২২৪, যে মাত্রা খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন- শ্রীপুরে এবারও ফুটেছে ১২ রঙের ৭০ হাজার টিউলিপ
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, একিউআই ১০১-১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১-২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়। আর একিউআই ২০১-৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ পেরিয়ে গেলে সেই বাতাসকে বিপজ্জনক ধরা হয়।
Advertisement
গাজীপুরে বায়দূষণ বন্ধ করতে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান। অভিযান চালিয়ে নির্মাণসামগ্রী খোলা অবস্থায় মজুত, পরিবহন ও পানি স্প্রে না করে বায়ু দূষণ করায় ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি মহাসড়ক নির্মাণকারী দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার করে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ (বিধিমালা) ২০২২ এর ধারা ১১ লঙ্ঘন করায় প্রতিষ্ঠান দুটিকে জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
গাজীপুর তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের ভিড় হাসপাতালে বাড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে একই অবস্থা রয়েছে। হাসপতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার রোগী আসে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই শ্বাসকষ্টজনিত রোগী। দূষণের কবলে পড়ে মানুষের হার্ট, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বায়ুদূষণজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট, এজমা, সিওপিডি ইত্যাদি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর নগরীর টঙ্গীর স্টেশন রোড, কলেজ গেইট, মেইল গেইট, টঙ্গী বাজারসহ বেশ কিছু এলাকার বায়ুর প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ধুলিকণা ও দূষিত পদার্থের পরিমাণ ২০০ থেকে সাড়ে ২২৪ মাইক্রোগ্রামে ওঠানামা করছে। যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা ১৬৫ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গীর সরকারি হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল এলাকাও রয়েছে ভয়াবহ দূষণের কবলে।
আরও পড়ুন- ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল
অন্যদিকে গাজীপুর শহর ও আশপাশের এলাকায় স্টিল মিলসহ নানা ধরনের কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়ায়ও বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাতাস। বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সকাল থেকে ধুলার আবরণে ঢাকা পড়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। বছরের পর বছর ধরে চলা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের কোনো পরিকল্পনা না থাকায় ধুলা-বালি বেশি ছড়াচ্ছে।
গাজীপুর নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধুলা-বালির কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। বাইরে যাওয়া-আসার পথে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ধুলা-বালিতে চরম ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।
গাজীপুর নগরীর ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। ধুলা-বালিতে একাকার অবস্থা। ঢাকা-বাইপাস সড়কের কাজের কারণে ধুলা আরও বেশি উড়ছে। ধুলা-বালি বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।
মিরের বাজার এলাকার বাসিন্দা এমারত হোসেন বলেন, কাজ করার সময় প্রকল্পের লোকদের পানি ছিটিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা দিচ্ছে না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন থেকেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যার কারণে তারা ধুলা-বালির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত রোগী আসছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে। এর মূল কারণ অতিরিক্ত বায়ুদূষণ।
তিনি বলেন, এর থেকে রক্ষা পেতে আমাদের নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করতে হবে যেমনটা আমরা করোনাকালীন সময়ে করেছি।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুর শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা হওয়ায় এবং এখানে মেগা প্রজেক্ট চলতে থাকায় বর্তমানে দূষণ একটু বেশি হচ্ছে। নির্মাণ সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে না চলায় বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। তাদের সীমিত জনবল নিয়েও দূষণরোধে জরিমানাসহ নানা ধরনের তৎপরতা রয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হচ্ছে।
এফএ/জিকেএস