রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নুজহাত ফারিয়া রোকসানা ওরফে রোকসানা আক্তারের বিরুদ্ধে। এছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ করেছেন। অভিযুক্ত নেত্রী ইডেন কলেজের গণিত বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার অনুসারী।
Advertisement
গত মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলেজের ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের ৫০৬ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত রোকসানা আক্তার এবং ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী একই কক্ষে থাকেন।
এ ঘটনার পরপরই হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হল সুপার নাজমুন নাহারকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের কপির একটি ছবি জাগো নিউজের হাতে এসেছে।
অভিযোগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা বঙ্গমাতা হলের পঞ্চম তলার সাধারণ শিক্ষার্থী। আমরা ওই ঘটনায় সশরীরে উপস্থিত ছিলাম। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রোকসানা আক্তার এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে (নিরাপত্তাজনিত কারণে ছাত্রীর নাম গোপন করা হচ্ছে। তবে ওই অভিযোগের কপিতে ছাত্রীর নাম রয়েছে) নির্যাতন শুরু করেন। তখন তার চিৎকারে আমরা আশপাশের রুমের ছাত্রী-আপুরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। তখন আমরা জানতে পারি, ভর্তিচ্ছু বহিরাগত শিক্ষার্থীদের হলে সিট দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেত্রী রোকসানা। অথচ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে লিগ্যাল (বৈধ) করে এক বছর ধরে পলিটিক্যাল রুমে রাখা হয়েছে এবং প্রতিদিন অত্যাচার-নির্যাতন করতেন। আজ ওই শিক্ষার্থী এটার প্রতিবাদ করলে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে রোকসানা তাকে স্টাম্প দিয়ে শরীরে আঘাত করেন। তার জামা-কাপড় ছিঁড়ে দেন, চুল ছিঁড়ে ফেলেন এবং বঁটি দিয়ে মারতে উদ্যত হন। পুরো পঞ্চম তলার শিক্ষার্থীরা রোকসানার অত্যাচারের শিকার। অতএব, আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই এবং এর বিচার চাই।’
Advertisement
আরও পড়ুন>> ইডেন ছাত্রীদের ‘অনৈতিক কাজে’ বাধ্য করার প্রমাণ মেলেনি
একটি গোপন সূত্রের মাধ্যমে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের কিছু ছবিও জাগো নিউজের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা যায়, ওই শিক্ষার্থীর হাতের কয়েকটা আঙুল কেটে গেছে। শিক্ষার্থীর গায়ের কাপড়ও (জার্সি) কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। পিঠে আঘাতের চিহ্ন। (ছবিগুলো প্রকাশযোগ্য না হওয়ায় তা প্রকাশ হলো না)।
বঙ্গমাতা হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছাত্রলীগের রোকসানা মেয়েদের দিয়ে নিজের কাজ করান। এমনকি তিনি যখন বের হন তার জুতা পর্যন্ত মেয়েদের পরিয়ে দিতে হয়। হাত-পা টেপান। ঘটনাস্থলে আমিও ছিলাম। রোকসানা আপু ওই মেয়েকে পিটিয়েছেন। উনি সবসময়ই এরকম করেন।
মেয়েদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালান। কথা না শুনলে গালিগালাজ করেন, রুম থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। টাকার বিনিময়ে মেয়েদের হলে ওঠান, হলে রাখেন। রোকসানা টাকার বিনিময়ে বহিরাগত শিক্ষার্থীদেরও হলে রাখেন। বঙ্গমাতা হলে পুরো পাঁচ তলায় শিক্ষার্থীরা ওর ভয়ে তটস্থ। উনি সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। কিছু বললেই স্টাম্প দিয়ে মারতে চান। আজ ওকে (ভুক্তভোগী) বঁটি দিয়ে কোপাতে গেছেন, ওর ঘাড়ে বঁটি দিয়ে কোপ দিয়েছেন। আমরা না ধরলে ওর শরীরে কোপ লাগতো।’
Advertisement
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী রোকসানা আক্তার বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্র। যে মেয়েকে নিয়ে আপনারা কথা বলছেন ও আমার রুমমেট। ছোট বোন। তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। জাস্ট একটু কথাকাটাকাটি হয়েছে। এখন আপনারা বলছেন স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়েছে। আপনারা চাইলে ওকে দেখতে পারেন বা ওর সঙ্গে কথাও বলতে পারেন। নির্যাতনের বিষয়টি সত্য নয়। রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করার জন্যই এত মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’
আরও পড়ুন>> ইডেন ছাত্রলীগের আরও দুই নেত্রীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার
ঘটনার পর হল সুপার নাজমুন নাহারকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ দেওয়ার সময়ের ২১ মিনিটের একটি অডিও জাগো নিউজের হাতে এসেছে। যেখানে হল সুপারকে বলতে শোনা যায়, ‘এই অভিযোগপত্র কে লিখেছে? খাতার মার্জিন দাওনি কেন? এতে ভুল কেন?’ এরপর শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ম্যাম তাড়াতাড়ি করে লেখার কারণে কিছু ভুল হয়েছে।’ জবাবে হল সুপার বলেন, ‘একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখতে পারো না ঠিক করে। অ্যাপ্লিকেশনের ভাষাও তো ঠিক নেই।’
এরপর হল সুপারকে অ্যাপ্লিকেশনের প্রতিটা লাইন পড়ে ভুল ধরতে দেখা যায়। এসময় তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধমকও দেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হল সুপার নাজমুন নাহারকে ভুক্তভোগীর শিক্ষার্থীর গায়ের রক্ত দেখান। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তখন কাঁদতে কাঁদতে হল সুপারকে বলেন, ‘ম্যাম আমাকে স্টাম্প দিয়ে মারছে, বঁটি দিয়ে মারতে আসছে।’ এসময় হলের অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল সুপারের কাছে রোকসানার নির্যাতনের বর্ণনা দিতে শোনা যায়।
অডিও’র ১৯ মিনিটে এক নেত্রী রুমে প্রবেশ করে সব শিক্ষার্থীকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। ওই নেত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘যার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে শুধু সে থাকবে- বাকি সবাই বের হয়ে যাও।’ এরপর ওই রুমে আরও কয়েকজন নেত্রী ঢুকে হল সুপারের সামনেই শিক্ষার্থীদের ধমকাতে থাকেন। তারা বকাঝকা করে সব শিক্ষার্থীকে রুম থেকে বের করে দেন।
এসব বিষয়ে জানতে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের হল সুপার নাজমুন নাহারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেননি।
আরও পড়ুন>> শিক্ষার্থীকে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ভিত্তিহীন: ইডেন অধ্যক্ষ
এ বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানকে একাধিকবার ফোন দিলে তারাও রিসিভ করেননি। ফোন রিসিভ করেননি ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাও ৷
এর আগে গত বছরের ১০ এপ্রিল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের পঞ্চম তলার ৫০৭ নম্বর কক্ষে সিট দখল করতে গিয়ে ওই কক্ষের বৈধ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন অভিযুক্ত রোকসানা আক্তার ও তার অনুসারীরা। তখন চার নম্বর বেডের শিক্ষার্থী ফারিয়া হক অর্পিতাকে ছাত্রলীগের এই নেত্রী ও তার অনুসারীরা মারধর করেন। একপর্যায়ে মারধরের শিকার ওই শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এরপর মারধরের ঘটনায় কলেজ ও হল থেকে অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর বহিষ্কারাদেশ চেয়ে ১১ এপ্রিল দুপুরে অধ্যক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে রোকসানাকে হল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও নেয় ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে অদৃশ্য কারণে তখন রোকসানার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কলেজ প্রশাসন।
ইএ/জেআইএম