আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে মেট্রোরেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের বিমা করা হয়েছে। এ ধরনের অবৈধ বিমা করা হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও রূপালী ব্যাংকের সম্পদের ক্ষেত্রেও। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিমা করা যায় না স্বীকার করে ঠিকাদারের বিমা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন।
Advertisement
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা মেট্রোরেল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) একাধিক বিমা পলিসি অবৈধভাবে গ্রহণ করেছে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স।
আরও পড়ুন>> অবৈধ ব্যয়ে জীবন বীমা কর্পোরেশন
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও রূপালী ব্যাংকের সম্পদ অবৈধভাবে বিমা করেছে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সম্পদ অবৈধভাবে বিমা করেছে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স।
Advertisement
বিমা করপোরেশন আইন ২০১৯-এর ১৬(১) ধারা লঙ্ঘন করে এই তিন বিমা কোম্পানি এসব সরকারি সম্পদের বিমা করেছে। অবৈধভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিমা করায় কোম্পানি তিনটির কাছে বিমা প্রিমিয়াম বাবদ নেওয়া অর্থ ফেরত চেয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।
একই ধারার বিধান অনুযায়ী, সব সরকারি বিমাযোগ্য সম্পদের বিমাঝুঁকি সাধারণ বিমা করপোরেশন থেকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স আইন লঙ্ঘন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের অনুকূলে ইস্যু করেছে সাতটি বিমা পলিসি।
আরও পড়ুন>> জীবন বিমার অবৈধ ব্যয় বাড়ছেই
এই সাতটি বিমা পলিসি ইস্যু করে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ভ্যাটসহ প্রিমিয়াম বাবদ চার কোটি ৮০ লাখ ৩৫ হাজার ৭৮৫ টাকা আদায় করেছে। একই সঙ্গে এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি বিমা আইন লঙ্ঘন করে ইস্যু করা প্রফেশনাল ইনডেমনিটি ইন্স্যুরেন্স (professional Indemnity Insurance) পলিসির বিপরীতে পুনঃবিমা করেছে।
Advertisement
এ ধরনের পুনঃবিমা করা বিমা আইনের বিধি-বিধান পরিস্থিতি উল্লেখ করে তা ‘বৈধ নয়’ বলছে সাধারণ বিমা করপোরেশন। এজন্য এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুনঃবিমা বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারি এ বিমা প্রতিষ্ঠানটি।
একই সঙ্গে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির অনুকূলে সাতটি বিমা পলিসি ইস্যু করে প্রিমিয়াম বাবদ গ্রহণ করা চার কোটি ৮০ লাখ ৩৫ হাজার ৭৮৫ টাকা গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের কাছে ফেরত চেয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।
আইন লঙ্ঘন করে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের বিমাযোগ্য সম্পদ বিমা করে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম বাবদ ৬০ লাখ ৩০ হাজার ১২৭ টাকা নিয়েছে। এই বিমা কোম্পানিটি রূপালী ব্যাংকের সম্পদও আইন লঙ্ঘন করে বিমা করেছে। রূপালী ব্যাংকের সম্পদ বিমা করে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম নিয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার ৫২৩ টাকা।
একই কারণে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের কাছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও রূপালী ব্যাংকের সম্পদের বিপরীতে বিমা প্রিমিয়াম বাবদ নেওয়া ৬১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫০ টাকা ফেরত চেয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।
আরও পড়ুন>> গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে ডায়মন্ড লাইফ
আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর বিমাযোগ্য সম্পদ বিমা করেছে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। এই বিমা কোম্পানিটি বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর বিমাযোগ্য সম্পদের বিপরীতে ৭১টি বিমাপত্র ইস্যু করেছে। এসব বিমাপত্র ইস্যু করে প্রিমিয়াম বাবদ নিয়েছে ২৯ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৩ টাকা। আইন লঙ্ঘন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিমা করায় ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের কাছেও প্রিমিয়াম বাবদ নেওয়া টাকা ফেরত চেয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ এম এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা অবৈধভাবে কোনো বিমা করিনি। পল্লী বিদ্যুতের বিমা হয়েছে টেন্ডারের মাধ্যমে। আমরা টেন্ডার বিট করেছি। শুধু আমরা না, অনেক কোম্পানিটি টেন্ডারে অংশ নেয়।
আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিমা কোম্পানি তো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিমা করতে পারে না, এরপরও কেন আপনারা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সম্পদ বিমা করলেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তার কোনো উত্তার না দিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ বিমা করপোরেশন কেন টেন্ডারে অংশ নেয়নি এটা তাদের কাছে প্রশ্ন করেন।
এ বিষয়ে বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. আমজাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা টেন্ডারের মাধ্যমে বিমা করেছি। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিমা করা হয়েছে। সাধারণ বিমা করপোরেশন টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেনি।
আইন অনুযায়ী আপনারা তো বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে বিমা করতে পারেন না। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা সব সময় টেন্ডারের মাধ্যমে বিমা করি। বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে বিমা করা যাবে না, এ ধরনের নিয়মনীতি বিষয়ে আমাদের কিছু জানা ছিল না।
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. জামিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সরকারি কোনো সম্পদের বিমা করিনি। আমরা যে বিমা করেছি সেটি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে কাজ করা চীনা নাগরিকের ব্যক্তিগত গাড়ির। এটাকেই সাধারণ বিমা করপোরেশন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের সম্পদের বিমা বলছে।
তবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো বিমা বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে করা নেই। কন্ট্রাক্টরের থাকলে থাকতে পারে। আমরা বিমা করলে সাধারণ বিমা করপোরেশনে করি।
আরও পড়ুন>> যুগ্ম-সচিবও হতে পারবেন বিমা কোম্পানির সিইও!
তিনি বলেন, আমার কন্ট্রাক্টর তাদের নিজস্ব কাজে ব্যবহারের জন্য যদি কোনো ইক্যুইপমেন্ট, মেশিনারিজ বিদেশ থেকে আনে তখন.... ইয়ে না। তারপরও আমরা উৎসাহিত করি কমপক্ষে যেন ৫০ শতাংশ বিমা সরকারি প্রতিষ্ঠানে করা হয়।
গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব অলিউল্লাহ খানের কাছে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি তো আপনারা বিমা করতে পারেন না, তাহলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের সাতটি বিমা পলিসি আপনারা কীভাবে করলেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেলের সরাসরি কোনো বিমা নেই। আমার ধারণা মেট্রোরেল প্রকল্পের বিমা হয়তো থাকতে পারে। আর গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সে আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো বিমা করা হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে করা যায় না, এটা আমরা জানি।
তিনি বলেন, আমার ধারণা গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে কন্ট্রাক্টরের (ঠিকাদার) বিমা থাকতে পারে। কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো বিমা গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে করা হয়নি। কন্ট্রাক্টর তো সরকারি না, সে স্বাধীন। কন্ট্রাক্টর কোথায় বিমা করবে, এটা তার এখতিয়ার।
বিষয়টি নিয়ে সাধারণ বিমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ বেলাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পদের বিমা যদি কেউ করে থাকে, সেক্ষেত্রে আইনগত যেসব বিষয় রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এমএএস/এএসএ/এএসএম