হলে ওঠার পর থেকে প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কিংবা বিভাগের সিনিয়রদের রুমে রুমে গিয়ে পরিচিত হতে হয় বলে জানিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) নবীন শিক্ষার্থীরা।
Advertisement
সিনিয়রদের রুমে কেন যেতে হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নবীন শিক্ষার্থী জানান, বিভাগের সিনিয়র কিংবা ছাত্রলীগের কোনো গ্রুপের মাধ্যমে তারা হলে উঠেছেন। হলে ওঠার পর থেকে সিনিয়রদের সঙ্গে পরিচিত হতে বলা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন রাতেই কোনো না কোনো রুমে যেতে হয়। কারও রুমে যেতে না চাইলে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়। ভয়ে বাধ্য হয়ে তাদের রুমে যান তারা। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়।
গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে কেন থাকতে হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, রুমে গেলে প্রথমে নিজের পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে কথাবার্তা শুরু হয়। পরে শুরু হয় নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সেখানে। অশ্লীল ভিডিও দেখানো, অশ্লীল গল্প পড়তে দেওয়া, নানা অঙ্গভঙ্গিতে হাঁটতে বলা, নাচানাচি করা কিংবা গান গাওয়া তো আছেই। একটু হাসলে বলা হয়, ‘তুই হাসলি কেন? তুই ১০ ধরনের হাসি হাসবি, সঙ্গে সেই হাসির নামও বলবি।’
‘সিনিয়র-জুনিয়র পরিচিতি পর্ব’ নামে এমন ঘটনা ঘটছে শাবিপ্রবির আবাসিক হলগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে বাড়তি টাকা গোনার ভয়ে হলে ওঠাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাই এমন বিরূপ আচরণেও তারা হল ছেড়ে যাবেন না জেনেই প্রতিনিয়ত এমন র্যাগিং করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
Advertisement
এদিকে, র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে শাবিপ্রবি প্রশাসন। নবীন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আগমনের পূর্বেই ‘নো র্যাগিং’, ‘র্যাগিং ইজ এ ক্রিমিনাল অফেন্স’ ও ‘র্যাগিং ইজ স্ট্রিক্টলি প্রোহিবিটেট’ ইত্যাদি নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় র্যাগিংবিরোধী ব্যানার লাগিয়েছে প্রশাসন। ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হলেও এসব নীতি তোয়াক্কা না করে পরিচিত হওয়ার নামে র্যাগিংয়ে জড়িত হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ‘ম্যানার’ শেখানোর নাম করে নানাভাবে র্যাগ দিচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীদের। র্যাগ কালচারের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না নবীন শিক্ষার্থীরা। ঝামেলায় জড়াতে চান না তারা, তবে র্যাগের এই মানসিক যন্ত্রণাও সহ্য করতে পারছেন না।
তবে এ অদৃশ্য ভয়ের দেওয়াল ভেদ করে বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর র্যাগিংয়ে শিকার হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে অভিযোগ দেন ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের নবীন এক শিক্ষার্থী। অভিযোগপত্রে লেখেন, গত সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ১১১ নম্বর কক্ষে ওই শিক্ষার্থীসহ তার বন্ধুরা র্যাগের শিকার হন তারই বিভাগের সিনিয়রদের কাছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে অধিকতর তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনও করে প্রশাসন।
র্যাগিংয়ের বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের অবস্থানের কথা জানতে একাধিক গ্রুপের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, গ্রুপের সবাইকে র্যাগ না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরেও যদি কেউ র্যাগিংয়ে জড়িত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাগিংয়ের অভিযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে উল্লেখ করে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, র্যাগের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ করার জন্য আমরা উৎসাহিত করি। এরইমধ্যে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় র্যাগিংবিরোধী ব্যানার লাগানো হয়েছে। যদি কোনো শিক্ষার্থী র্যাগের শিকার হন, তাহলে র্যাগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Advertisement
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে কল দিলে রিসিভ করেননি। তবে তিনি এর আগে র্যাগিংয়ে জিলো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, র্যাগিংয়ের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করি। কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আমার সাথেও যোগাযোগ করবে। আমরা ওরিয়েন্টেশনে বলে দিয়েছি, কেউ পরিচিত হওয়ার জন্য ডাকলে তাদের ডাকে সাড়া না দিতে।
নাঈম আহমদ শুভ/এমআরআর/এএসএম