বৈশ্বিক প্রযুক্তিখাতের চাকরির বাজারে বিগত বছর থেকেই অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক, টুইটার, মাইক্রোসফট, স্পটিফাইসহ শীর্ষস্থানীয় সব কোম্পানিই কম-বেশি কর্মী ছাঁটাই করেছে। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি বাংলাদেশেও।
Advertisement
উদীয়মান টেক-শক্তি হিসেবে পরিচিত ভারতে ২১ হাজারের বেশি প্রযুক্তিকর্মী চাকরি হারিয়েছেন কয়েক মাসে। তারা কাজ করতেন ‘সুইগি’, ‘বাইজুস’, ‘ওলা’, ‘ওওয়াইও’ এবং ‘আনএকাডেমি’ এসব শীর্ষ স্টার্ট অ্যাপগুলোতে। বাংলাদেশে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ডিজিটাল সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম ‘সহজ’, ‘পাঠাও’, ‘হাংরিনাকি’, ‘দারাজ’, ‘ফুডপান্ডা’ সম্প্রতি কর্মীদের চাকরিচ্যুতের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কিছু বিষয় মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে- এই সংকট মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার সবসময়ই সভ্যতার চালিকাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে এসেছে। বড় বড় মানবিক বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনকে করেছে নির্বিঘ্ন ও গতিময়।
Advertisement
আজকাল সাত-সকালে আমাদের ঘুম ভাঙছে, হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট বা কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সহযোগীর শুভেচ্ছাবার্তায়, প্রায় নির্ভুলভাবে জানতে পারছি সারাদিনের আবহাওয়া পূর্বভাস। এছাড়া, রাইড শেয়ারি, ই-কমার্সসহ প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্নসেবা অঙ্গাঙ্গিকভাবে আমাদের জীবনযাত্রায় জড়িয়ে পড়েছে।
তবে প্রযুক্তিনির্ভরতায় দৃশ্যত বড় পরিবর্তনটা এসেছে ২০২০ সালে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ মহামারির সময়কালে। বিশ্বজুড়ে হওয়া এ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে মানুষ প্রযুক্তির কাছে নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে। এই সময়ে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদাকে সামনে রেখে কোম্পানিগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার সহজলভ্য করতে চেষ্টা করেছে। তাই প্রযুক্তির বাজারে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বহুগুণে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মুনাফা বেড়েছে হু হু করে, সম্পদশালী হয়েছেন সিলিকন ভ্যালির বাঘা বাঘা উদ্যোক্তা। তবে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি বদলেছে। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি প্রযুক্তিবিমুখ না হলেও সহজাত জীবনের ছোঁয়া পেতে চেয়েছে। স্বভাবতই ধাক্কা লেগেছে প্রযুক্তিখাতের আয়-রোজগারে আর তৈরি হয়েছে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পরিস্থিতির।
করোনা পরবর্তী সময়ে এবং এ বছরের শুরু থেকে যেভাবে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে চারকিরচ্যুতি হচ্ছে তাতে টেক ইন্ডাস্ট্রির অস্থিরতা অনেকের মধ্যে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। Layoffs.fyi-এর সূত্রমতে ২০২২ সালে ১ হাজার টেক কোম্পানি দেড় লাখের বেশি কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছে। তবে কিছু কিছু সূত্র বলছে সবমিলিয়ে এ সংখ্যা ২.৫ লাখের বেশি।
Advertisement
চলতি বছরের সম্ভাব্য মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি ও সবমিলিয়ে কোম্পানিগুলোর ওপর বিনিয়োগকারীদের চাপ এই গণছাঁটাইয়ের কারণ। একইসঙ্গে কোভিড-১৯ সময়ে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত নিয়োগ ও কোভিড-১৯ পরবর্তী বাস্তবতাও কোম্পানিগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টা সত্যিকার অর্থে এতটা হতাশাব্যঞ্জকও নয়।
কারণ টেক সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের একটা বড় অংশ কাজ করেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডেটা সায়েন্টিস্ট, ডেভেলপার, ক্লাউড আর্কিটেক্টসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ভূমিকায় এবং তাদের প্রযুক্তিলব্ধজ্ঞানের চাহিদা মোটেই কমছে না বরং ভবিষ্যতে বেড়েই চলবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্ট্রিমিং সার্ভিস ব্যবসায় নেটফ্লিক্স চমক সৃষ্টি করেছিল যখন এই খাতে প্রতিযোগীরা তেমন একটা বিনিয়োগ শুরু করেনি।
নেটফ্লিক্স খুব অল্প সময়ে দ্রুত কর্মী বাড়িয়ে ব্যবসায় প্রসার ঘটায়। কিন্তু পরে ডিজনি, প্যারামাউন্ট, অ্যামাজন প্রাইমসহ আরও অনেকে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিসে নাম লেখায় ও কর্মী নিয়োগ দেয়। নেটফ্লিক্সের একচেটিয়া দাপট প্রশমিত হলেও স্ট্রিমিং সার্ভিসকেই বিনোদন প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ হিসেবে এখনো দেখা হচ্ছে।
ফেসবুক গত নভেম্বরে বিশ্বজুড়ে ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে সিলিকন ভ্যালি পাড়ায় যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তার ধারাবাহিকতা অন্যান্য কোম্পানিতেও দেখা গেছে। অ্যামাজন, পে-প্যাল, গুগল, কিংবা মাইক্রোসফট- প্রযুক্তির কান্ডারিরা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়।
এ ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ নেই যে চাকরিচ্যুতি অনেক ক্ষেত্রেই কর্মীদের মানসিক অবসাদের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তবে বিগ টেক কোম্পানিগুলোর মানবসম্পদ নীতিমালায় নজর দিলে অনুধাবন করা যায় যে, কর্মীদের চাকরি পরবর্তী জীবন নিয়েও মানবিক ও আর্থসামাজিক উদ্যোগ নিয়ে থাকে কোম্পানিগুলো। ৯ নভেম্বর, ২০২২ এ মেটা এর প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ একটি অফিশিয়াল বার্তা পাঠান চাকরিচ্যুত কর্মীদের। সেখানে উল্লেখ করা হয় ছাঁটাই হওয়া সব কর্মী চার মাসের মূল বেতন, পরিবারসহ ছয় মাসের স্বাস্থ্য বিমা এবং পরবর্তী চাকরিপ্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করবে মেটা।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি সেবাখাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে সাধারণ মানুষকে ই-কমার্স, ফুড, কুরিয়ারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি ব্যবসায় পরিবর্তন আসায় ভুগতে হয়েছে, ‘সহজ’, ‘পাঠাও’, ‘হাংরিনাকি’, ‘দারাজ’ এর মতো কোম্পানিগুলোকে।
এছাড়া, সম্প্রতি ফুডপান্ডার মূল প্রতিষ্ঠান ‘ডেলিভারি হিরো’ ইতোমধ্যে বার্লিনের প্রধান কার্যালয় থেকে ১৫৬ জনকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। সে আঁচ হালকাভাবে লেগেছে ফুডপান্ডা বাংলাদেশেও।
একটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ্য- চাকরি খোঁজার জনপ্রিয় ওয়েবসাইট জিপ রিক্রুটার বলছে, সামগ্রিক চাকরির বাজার খানিকটা দোদুল্যমান হলেও বিগ টেক প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত কর্মীরা অন্য যে কারও তুলনায় দ্রুত বিকল্প কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হতে পারছেন। প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ কর্মীদের চাহিদা সব খাতেই বেশি থাকায় চাকরি হারালেও দ্রুত অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে পাওয়ায় খুব একটা সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। তাই যারা চাকরি হারাচ্ছেন- তার অন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রি অথবা বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে এই চ্যালেঞ্জিং সময়টায় নিজের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছেন।
টেক ইন্ডাস্ট্রি বা প্রযুক্তিখাতের চাকরির বাজার প্রধানত প্রবৃদ্ধিনির্ভর। তাই এই সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য ব্যবহারকারীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পণ্য কিংবা সেবার অভিনবতা ও কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে কোম্পানিগুলোকে ভাবতে হবে।
২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে নিয়ে এসেছে। তাই সরকার প্রথমে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ-২০২১’ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এবং বর্তমানে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ ভিশনকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের সফলতার ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বজনীন ব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ই-কমার্স, কুরিয়ার সার্ভিস, রাইডার সেবা, ফুড ডেলিভারি, টেলি-মেডিসিনের মতো ডিজিটাল জীবন ব্যবস্থার সুফল পাচ্ছেন ভোক্তা ও গ্রাহকরা। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি মূলভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি।
এসব রূপকল্প বাস্তবায়নে ডিজিটালখাত নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিকল্প নেই। তাই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ডিজিটাল সার্ভিস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকার ও অংশীদারদের ইতিবাচক দৃষ্টি এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে এই সাময়িক সংকট কাটিয়ে প্রযুক্তিখাত পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক: যোগাযোগ ও গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/ফারুক/এএসএম