নওগাঁয় মিশ্র ফল বাগানে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। কৃষি অফিসের পরামর্শে বিভিন্ন ফল ও সবজির দাম ভালো পেয়ে লাভবান হওয়ায় অনেকেই কৃষিতে মনোনিবেশ করছেন। যেখানে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে সার্বিক সহযোগিতা পেলে দ্রুত এ পেশায় উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
Advertisement
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৪৫৩ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের বরইয়ের (কুল) বাগান গড়ে উঠেছে। যেখান থেকে প্রায় ৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বরই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতি কেজি ৮০ টাকা হিসেবে ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর ৩৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের বরইয়ের বাগান ছিল। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বরই চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।
নওগাঁ সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের মকমলপুর গ্রামের লিটন হোসেন। এক সময় ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় রডমিস্ত্রির কাজ করতেন। কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় তাকে জেলার বাইরে থাকতে হতো। রডমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে গত দুই বছর কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন। নিজের জমি না থাকায় বেসরকারি সংস্থার ঋণ ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে ৫ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে বরই ও সবজি আবাদ শুরু করেন।
আরও পড়ুন: লোকসান ঠেকাতে আগাম তরমুজ চাষ
Advertisement
এ বছর তা বাড়িয়ে ১৭ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে মিশ্র ফলের বাগান করেছেন। সেখানে ৭ বিঘা জমিতে বরই (বলসুন্দরি, আপেল কুল, টক-মিষ্টি কুল ও নারকেলি), ৭ বিঘায় পেয়ারা, ৩ বিঘায় আম বাগান ও বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছেন। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। লেখাপড়ার পাশাপাশি এ বাগানে কাজ করে বাড়তি টাকা আয় করছেন শিক্ষার্থীরা। তার দেখাদেখি এলাকায় অনেকেই কৃষিতে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী হচ্ছেন এবং পরামর্শ নিচ্ছেন।
উদ্যোক্তা লিটন হোসেন বলেন, ‘নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এরপর বিভিন্ন কাজ করে সংসার চলতো। প্রায় ১০ বছর বিভিন্ন জেলায় রডের কাজ করতাম। এ কাজ কঠিন। বলা যায়, সারাবছরই বাড়ি বাইরে থাকতে হতো। চার বছর আগে সংসার শুরু করেছি। গ্রামে কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকেই রডের কাজ ছেড়ে দিয়েছি। বাড়ি-ঘর ছাড়া নিজের কোনো জমি নেই। গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন ফল ও শাক-সবজির আবাদ করছি।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর জমি, শ্রমিক ও আবাদে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি বিঘা জমি প্রতি বছরের জন্য ২০-২৫ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছি। এ বছর প্রায় ১০ লাখ টাকার বরই বিক্রি হবে। ইতোমধ্যে ৫ লাখ টাকার বরই বিক্রি হয়েছে। জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ থেকে বরই উত্তোলন শুরু হয়। সে সময় দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা মণ। দাম কমে বর্তমানে ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: তরমুজে ঘুরবে বরগুনার অর্থনীতির চাকা
Advertisement
লিটন আরও বলেন, ‘এ বাগানের পেয়ারা ও সবজি বিক্রি হবে আরও প্রায় ১০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মিশ্র ফল বাগান থেকে ২০ লাখ টাকার ফল ও সবজি বিক্রি হবে। খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকবে প্রায় ৮ লাখ টাকা। নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও ৮-১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাগানটি সম্প্রসারণ করে আগামীতে আরও ৫০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ইচ্ছা আছে।’
শিক্ষার্থী পিয়াস হোসেন বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি গত দুই বছর ধরে লিটনের বাগানে কাজ করছি। দিনে ২০০-২৫০ টাকা মজুরি পাই। এ টাকা দিয়ে পড়াশোনার কাজে খরচ করায় বাড়ি থেকে কোনো টাকা নিতে হয় না। আমার মতো আরও দুজন এ বাগানে কাজ করেন।’
জেলার বদলগাছী উপজেলার ভাতশাইল গ্রামের যুব এগ্রো ফার্মের উদ্যোক্তা পলাশ হোসেন বলেন, ‘প্রায় ১৪ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফলের বাগান আছে। এরমধ্যে আট বিঘা আমের বাগানের মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে বরই লাগানো হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ায় বরই লাভজনক। ৩-৪ বছর পর কেটে ফেলে আবারও লাগানো যায়। উৎপাদনের শুরুতে বরইয়ের দাম ভালো থাকলেও বাজারে সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে যায়। তবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে ভালো দাম পাওয়ার পাশাপাশি লাভবান হওয়া সম্ভব।’
সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রতন আলী বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে লাভবান হওয়া সম্ভব, তা উদ্যোক্তা লিটন হোসেনকে দেখেই বোঝা যায়। তার বাগান দেখে এখন অনেকেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এবং পরামর্শ নিচ্ছেন কীভাবে বাগান করলে লাভবান হওয়া সম্ভব। কৃষিতে আগ্রহ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের কারিগরিসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: টমেটোর নতুন জাত ‘সাউ রেড রুবি’ উদ্ভাবন
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার এ কে এম মনজুরে-মাওলা বলেন, ‘বর্তমান সরকার কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণে কাজ করছে। কৃষি লাভজনক না হলে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তবে কৃষক এবং উদ্যোক্তারা ভালো দাম পাওয়ায় তাদের বিভিন্ন ফল বা মিশ্র বাগানে আগ্রহ বাড়ছে। মিশ্র ফল বাগানের ফলে সারাবছরই ফল বিক্রি হবে এবং চাষিরা লাভের মুখ দেখবেন। তরুণ বিশেষ করে শিক্ষিত উদ্যোক্তারা এখন কৃষিতে এগিয়ে আসছেন। জমির উর্বর শক্তি বাড়াতে ও খরচ কমাতে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জৈব ও ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
আব্বাস আলী/এসইউ/এএসএম