কোরআনে ঘোষিত জঘন্য এক অপরাধের নাম অপবাদ। অপবাদের কারণে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। নষ্ট হয় সামাজিক সংহতি ও পারিবারিক বন্ধন। এমনকি জাতীয় ঐক্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপবাদ ইসলামে যেমন নিষিদ্ধ তেমনিভাবে সামাজিকভাবেও একটি ঘৃণিত অপরাধ। অপবাদের রয়েছে শারীরিক শাস্তি। সামাজিকভাবে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। পরকালের শাস্তি তো আছেই।
Advertisement
হ্যাঁ, অপবাদ দেওয়া গুনাহের কাজ। কোরআনে পাকে অপবাদ দানকারী ব্যক্তিকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই অপবাদের মাধ্যমে একজন মানুষ আরেকজনের মান-মর্যাদা বিনষ্ট করে দেয়। অপবাদের মাধ্যমে ব্যক্তি অপরের ক্ষতি করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও ক্ষতি করে। নিজেকে কবিরা গুনাহে লিপ্ত করে।
অনুমানের উপর ভিত্তি করেই সবচেয়ে বেশি অপবাদের ঘটনা ঘটছে।এটি নিরপরাদ মানুষের জন্য রীতিমতো মহামারী। গল্প, গুজব, আড্ডা যত যাই হোক যেন অন্যের দুর্নাম, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া না হলে সে আড্ডা জমে না। সর্বত্রই অন্যের দোষচর্চা অনেকের কাছে খোশ-গল্পের মতো। অনেক সময় অপবাদের ধরণগুলো এমন হয়-
‘অমুক পুলিশের চাকরি করে, তার বাড়ি গাড়ি সব ঘুষের টাকায়। অমুক বন বিভাগে চাকরি করে, তার সব সম্পদ ঘুষের টাকায়। অমুক ব্যাংকে চাকরি করে, তার সব সুদের টাকায়।’
Advertisement
বর্তমান সমাজে গল্প গুজবে এসব বলা রীতিমতো মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এ অপবাদ কখনো কখনো মানুষকে কুফরি পর্যন্ত নিয়ে যায়। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে ইচ্ছাকৃত কিংবা ভুলে কেউ রাসুলের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ রটনা করলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে অপবাদ দেওয়া প্রসঙ্গে ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-
‘কেউ যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয় অথবা তাকে মিথ্যারোপ করে বা তার ব্যাপারে অপবাদ রটনা করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।‘ (আহকামুল কুরআন ৪ /২৭৫)
কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ অপবাদের মতো অপরাধ করা ব্যক্তিকে অভিশপ্ত এবং তাদের কঠোর শাস্তি করা উল্লেখ করে বলেন-
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَرۡمُوۡنَ الۡمُحۡصَنٰتِ الۡغٰفِلٰتِ الۡمُؤۡمِنٰتِ لُعِنُوۡا فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۪ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
Advertisement
‘নিশ্চয়ই যারা সচ্চরিত্রবান সরলমনা মুমিন নারীদের ব্যভিচারের অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য (আখিরাতে) আছে মহা শাস্তি।’ (সুরা নুর : আয়াত ২৩)
অপবাদ জঘন্য অপরাধ। এর শাস্তিও মারাত্মক। অপবাদ মানুষকে কোনো কারণ ছাড়াই অপরাধী হিসেবে তুলে ধরে এবং সম্মান ও ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে তুলে ধরে। আল্লাহ ব্যভিচারের অপবাদকে গুরুতর অপরাধ বলে সাব্যস্ত করেছেন এভাবে-
وَّ تَحۡسَبُوۡنَهٗ هَیِّنًا ۖ وَّ هُوَ عِنۡدَ اللّٰهِ عَظِیۡمٌ
‘তোমরা ব্যাপারটিকে (অপবাদকে) তুচ্ছ মনে করছ; অথচ তা আল্লাহর কাছে খুবই গুরুতর অপরাধ।’ (সুরা নুর : আয়াত ১৫)
অপবাদের মাধ্যমে নির্দোষ ব্যক্তির চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়। সচ্চরিত্রবান নারীদের ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া কঠিন অপরাধ। এজন্য এর শাস্তিও কঠিন ।
অপবাদের শাস্তি
আল্লাহ তাআলা অপবাদের অন্যায়কে শুধু অভিশপ্ত ও পরকালের শাস্তির কথা বলেই থেমে থাকেননি বরং দুনিয়াতেও তাদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট শারীরিক শাস্তির ঘোষণা। এমনকি তাদের সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ الَّذِیۡنَ یَرۡمُوۡنَ الۡمُحۡصَنٰتِ ثُمَّ لَمۡ یَاۡتُوۡا بِاَرۡبَعَۃِ شُهَدَآءَ فَاجۡلِدُوۡهُمۡ ثَمٰنِیۡنَ جَلۡدَۃً وَّ لَا تَقۡبَلُوۡا لَهُمۡ شَهَادَۃً اَبَدًا ۚ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ۙ
‘যারা সচ্চরিত্র নারীর প্রতি অপবাদ দেয়, তারপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না। তাদের আশিটি চাবুক মারবে এবং তাদের সাক্ষ্য কখনও গ্রহণ করবে না। তারা নিজেরাই তো ফাসেক।’ (আন নুর : আয়াত ৪)
কারো সম্মানহানি করার অধিকার অন্যের নেই। আর মিথ্যা অপবাদে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। যে মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের ইজ্জত খাটো করে তার সম্পর্কে হাদিসে পাকে কঠোর হুশিয়ারি এসেছে এভাবে-
হজরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ ও আবু তালহা ইবনু সাহল আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَا مِنَ امْرِئٍ يَخْذُلُ امْرَأً مُسْلِمًا فِي مَوْضِعٍ تُنْتَهَكُ فِيهِ حُرْمَتُهُ وَيُنْتَقَصُ فِيهِ مِنْ عِرْضِهِ، إِلَّا خَذَلَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ فِيهِ نُصْرَتَهُ، وَمَا مِنَ امْرِئٍ يَنْصُرُ مُسْلِمًا فِي مَوْضِعٍ يُنْتَقَصُ فِيهِ مِنْ عِرْضِهِ وَيُنْتَهَكُ فِيهِ مِنْ حُرْمَتِهِ، إِلَّا نَصَرَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ نُصْرَتَهُ
‘যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের মান-ইজ্জত নষ্ট হওয়ার স্থানে তাকে ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা থেকে বিমুখ থাকবেন যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের মান-ইজ্জত নষ্ট হওয়ার স্থানে তাকে সাহায্য করে আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন যেখানে সে তাঁর সাহায্য প্রত্যাশা করে।’ (আবু দাউদ ৪৮৮৪)
অপবাদ বান্দার হক। কারো ব্যাপারে অপবাদ দেওয়া হলে সে ক্ষমা না করলে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে না। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, অপবাদের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা। যাদের অপবাদ দিয়েছি তাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। এমনকি অন্যের ব্যাপারে অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকা। মহান আল্লাহর নির্দেশও এমন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ
‘হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুনাহ।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মিথ্যা অপবাদ থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম