কৃষি ও প্রকৃতি

পাট ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি

মো. জিহাদ

Advertisement

এ যাবৎ বাংলায় সোনালি আঁশ পাটের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা পাট চাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেছে। পাটের মান উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।পাটের ব্যবসার জাতীয়করণ, পাটের গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান টেলিভিশন ও রেডিও পাকিস্তানে এক ভাষণে আওয়ামী লীগপ্রধান ও বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিবুর রহমান পাটের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে একথা বলেছিলেন।

পাট বা সোনালি আঁশ হলো আমাদের বাংলার ঐতিহ্য। এই পাট এবং পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের এক সফল ইতিহাস, মিশে আছে আমাদের সংস্কৃতি ও নিজস্বতায়। আবহমান বাংলার প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতির এক বিরাট অংশ পাট ও পাট জাতীয় পণ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

আমরা ফিরে যাই ১৯৬৬ সালে; এ বছরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষণা করা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা। যেটিকে তুলনা করা হয় ম্যাগনাকার্টার সঙ্গে। এই ছয় দফার পঞ্চম দফা ছিল প্রদেশগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে এবং এর নির্ধারিত অংশ তারা দেবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য দাবি উত্থাপিত হয়েছে এতে। পরবর্তীতে এই ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা এবং এর পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল আমাদের এই সোনালি আঁশ।

Advertisement

আরও পড়ুন: ২ বছরের পরিশ্রমে মাসে ১৮ লাখ টাকার ফল বিক্রি

মহান স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু পাট খাতের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তার শাসনামলে ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু কাঁচা পাট ও পাটজাতীয় দ্রব্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। অর্থাৎ মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ এসেছে পাট থেকে।

কালের বিবর্তনে আমাদের দেশের পাটশিল্পের গৌরব আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে পাট উৎপাদন হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে, সেটি কমে কমে একসময় ৪-৪.৫ লাখ হেক্টর জমিতে পৌঁছায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে পরিবেশ সচেতনতা, পরিবেশবান্ধব পণ্য, প্রাকৃতিক আঁশের অপার সম্ভবনার এবং বিশ্ব বাজারে পাটজাতীয় পণ্যের চাহিদার কারণে আবারও পাটের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট পাট চাষ হয়েছে ৬.৮২ লাখ হেক্টর জমিতে এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট পাট চাষ হয়েছে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে।

বাংলাদেশ বর্তমানে পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক ফাইবারের চাহিদার কারণে পাটের রপ্তানি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাতীয় পণ্য সাধারণত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরান, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। করোনার কারণে আমাদের পোশাক, চামড়াসহ অন্য খাতের রপ্তানি আয়ে যখন ধস নেমেছিল; তখনো পাট শিল্প আমাদের রপ্তানি আয়ের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে সচল ছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশ পাট ও পাটজাতীয় পণ্য থেকে ১৯৫.৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে, যা আগের বছরের এসময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। আবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৯১ কোটি ডলার আয় করে। যার মধ্যে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার এসেছে পাট থেকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: ধানের বাদামি দাগ রোগ প্রতিকারে করণীয় জানালো কৃষি তথ্য সার্ভিস

পাটের সোনালি আাঁশ, পাটকাঠি এবং পাটপাতা–এই তিন মিলে আমাদের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে জিন্স, শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি, দরজা-জানালার পর্দা, বিভিন্ন খেলনা, পাপোশ, নকশি কাঁথা, শোপিসসহ প্রায় শতাধিক পণ্য। পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউরোপে এই পাট গাড়ি নির্মাণ, উড়োজাহাজ, কম্পিউটার, ইনস্যুলেশন শিল্পসহ নানাবিধ শিল্পে ব্যবহত হচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার পর্তুগিজ সেনসেশন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পায়ের জুতা বাংলাদেশের পাট দিয়ে তৈরি হয় (বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান মিয়া)। পাটকাঠি দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল, যা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এ চারকোল থেকে মেডিসিন, অ্যান্টি টক্সিক্যান্ট, ওয়াটার ফিল্টার, টুথপেস্ট, ফার্টিলাইজার, ফেসওয়াশ, কসমেটিকস, ফটোকপিয়ার, প্রিন্টারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

পাটপাতা আমাদের অর্থনীতির জন্য হতে পারে আরেকটি মিরাকল। বর্তমানে পাটপাতা থেকে তৈরি হচ্ছে অর্গানিক চা। পাটপাতা থেকে চা তৈরির জন্য টানা আট বছর গবেষণা করে সফল হয়েছেন টাঙ্গাইলের জাকির হোসেন তপু। এরই মধ্যে তা রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের কয়েকটি দেশে। তা এ দেশীয় যুবকদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তা ছাড়া ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে এ চা পাঠানো হয়। (মাই টিভি)

পাটের আরেকটি সম্ভাবনাময় দিক হলো মেস্তা পাট। পাট গবেষণা আঞ্চলিক কেন্দ্র রংপুরে গবেষণার মাধ্যমে মেস্তা পাট থেকে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, মেস্তাসত্ত্ব, চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ও পানীয়সহ হরেকরকম খাদ্যপণ্য। ধারণা করা হচ্ছে, এসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: মরিচ গাছের পোকা দমনে কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরামর্শ

জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আগামীর বিশ্বকে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রাকৃতিক ফাইবারের বিকল্প নেই। পলিথিনের মতো মাটি, পানি দূষণকারী পদার্থের একমাত্র বিকল্প হতে পারে প্রাকৃতিক ফাইবার তথা পাট। সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিকে আগামী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর যে লক্ষ্য, সেটি অর্জনে আমাদের অন্যতম চালিকাশক্তি হবে পাট ও পাটজাতীয় পণ্য। তাই পাট শিল্পের বিকাশে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব কাম্য।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব শাখা, পেস্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

এসইউ/এএসএম