মতামত

প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক শত্রুতা নয়

আমাদের দেশে নানা বিষয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আমরা পছন্দ করি। এক মত হওয়ার চেয়ে মতভিন্নতা অনেকের কাছে প্রিয় বিষয়। দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই তা নিয়েও বিতর্ক আছে। বিতর্ক খারাপ নয়। তবে সারাক্ষণ বিতর্কে মেতে থাকাও সুস্থতার লক্ষণ কি? আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মনে করেন তার সরকার নির্বাচিত।

Advertisement

হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ কখনো ষড়যন্ত্র করে কিংবা পেছন দরজা দিয়ে যে ক্ষমতায় আসেনি, এটা ঠিক। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের যে দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে, তার শুদ্ধতা নিয়ে আওয়ামী লীগবিরোরীরা উচ্চকণ্ঠ। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন যে যথাযথভাবে হলো না, তার জন্য আওয়ামী লীগ কতটা দায়ী? ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো অংশগ্রহণ করলে কি একতরফা নির্বাচন হতে পারতো অথবা ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারও জেতা সম্ভব হতো? বিএনপি কি আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগ করে দেয়নি?

যেহেতু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দল, সেহেতু এক দল আরেক দলকে ওয়াকওভার না দেওয়ার কৌশল থাকা দরকার। অথচ বিএনপি সব সময় চেষ্টা করে নির্বাচনী পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে সাজিয়ে তারপর নির্বাচন করতে। সেটা আওয়ামী লীগ কেন করতে যাবে? বিএনপি নিজের সুবিধা বুঝলে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে কেন উল্টোটা হবে?

ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই তাতে অংশ নিতে হবে এবং জনমতকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার উপায় বের করতে হবে। কোনো অজুহাতেই নির্বাচন থেকে দূরে থাকাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলা যাবে না। ভোটের ফলাফল প্রভাবিত করার ঘটনা ঘটাও অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। তবে জনমত পক্ষে না থাকলে কারচুপি করাও সহজ হয় না।

Advertisement

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বছর চলছে। এ বছর শেষেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ২০০৮ সালের পরের দুইটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগই জয়লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। পরপর তিন টানা মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। এখন প্রশ্ন উঠেছে, পরের নির্বাচনে কি আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে পারবে?

এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। এই বছরটি রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণ কেমন হয়, মানুষের মধ্যে যেসব কারণে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, সে কারণগুলো দূর করতে সরকার সফল হয় কি না, বিরোধী দল আন্দোলন জমাতে পারে কি না, আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের প্রতি কি মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হয়- ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

এরমধ্যেই অবশ্য এটা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে যে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা নয়, একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারেই আমেরিকার আগ্রহ বেশি। ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশে এখন একতরফা খবরদারি করা কোনো দেশের পক্ষে সহজ নয়।

বিএনপি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেছে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে গিয়ে বিএনপি কিছু কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। তবে এই ঐক্য খুব জোরদার হচ্ছে, তা বলা যাবে না। যদি ধরে নেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক শাসনের বদলে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালু করছে, তাহলে এই প্রশ্নও আসবে, বিএনপি কি ক্ষমতায় থাকতে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল?

Advertisement

আবার ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবে, তার নিশ্চয়তা কি? বিএনপি কি একটি গণতান্ত্রিক দল? দলের কোনো সিদ্ধান্ত কি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয়ে থাকে? কর্তৃত্ববাদী সরকার যদি খারাপ হয়, তাহলে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব কি ভালো? যারা নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বিলাপ করেন, তারা রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে মতপ্রকাশের বিষয়টি কি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন?

আমাদের দেশে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা যতটা হয়, রাজনৈতিক দলের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে, দলের অভ্যন্তরীণ শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। সরকারের সমালোচনা করে বিরোধী দল, বিরোধী দলের সমালোচনায় মুখর সরকার। নিজেদের ভুলত্রুটি নিজেরা দেখে না। দলগুলোতে আত্মসমালোচনা নেই, নেই আত্মশুদ্ধির কোনো তাগিদও।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগকে নানা রকম রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। বাধা-বিপত্তি কাটিয়েই পথ করে নিতে হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চিন্তা ও আদর্শিক অবস্থানে ভিন্নতা ছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নেও ছিল মতপার্থক্য। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্ষমতার মোহ, সুবিধাবাদ ইত্যাদি।

প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ভিন্ন মতাদর্শের একটি দল গড়ে তোলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ বলেও কারো কারো কাছে মনে হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর মতো জাঁদরেল ও জনপ্রিয় নেতা দলত্যাগ করার পর অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ শেষ, এই দল আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

তারপর দলের আরেক কান্ডারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দলের জন্য এক বড় আঘাত। এর সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম নির্যাতনমূলক বৈরী মনোভাব। যারাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির পতাকা নিয়ে সামনে আসতে চেয়েছেন তাদের ভাগ্যেই অবধারিতভাবে বরাদ্দ ছিল জেল-জুলুম-নির্যাতন।

সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ততদিনে বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে উদিত হয়েছে নতুন সূর্য, তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে আসা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবই যে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠবেন, তিনিই যে হবেন ইতিহাসের মহানায়ক, তিনি এ দেশের রাজনীতিতে তৈরি করবেন নতুন ইতিহাস সেটা তার সমকালের রাজনীতির অনেকেই বুঝতে পারেননি, আবার কেউ কেউ পেরেছিলেন। যারা পেরেছিলেন তারা শেখ মুজিবের সঙ্গী হয়েছেন, তার সহযাত্রী হয়েছেন।

এই বিশ্বস্ত অনুগামীরা যখন ১৯৬৬ সালের সম্মেলনে শেখ মুজিবের হাতে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব তুলে দেন তখনই কার্যত শুরু হয় আওয়ামী লীগের নতুন প্রাণস্পন্দন। শেখ মুজিবের হাত ধরেই আওয়ামী লীগ আসলে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে বাঙালির আপন দল, যে দলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

শেখ মুজিবকে দেশের মানুষ ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধিত করেছে। একজন অসাধারণ দক্ষ সংগঠক এবং একই সঙ্গ একজন সাহসী মানুষ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তুলনাহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক চিন্তা ও পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই দেশের মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই তিনি দেশের মানুষকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করেছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন আওয়ামী লীগের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম ঘটনা, তেমনি ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার হত্যা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিক ঘটনা। এত বড় আঘাত, এত বড় ক্ষতি আওয়ামী লীগ সামলে উঠতে পারবে, আওয়ামী লীগ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে- এটা তখন অনেকের কাছেই ছিল কষ্টকল্পনার বিষয়।

পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ভাঙার, হীনবল করার ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কম করেনি। ফল হয়েছে বিপরীত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় এটা আবার প্রমাণ হয়েছে যে ইতিহাসের সম্মুখযাত্রা কেউ সাময়িক বাধাগ্রস্ত করতে সফল হলেও স্থায়ীভাবে সেটা পারে না।

বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে টানা তিন মেয়াদে মোট চার বার ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের অনেক সাফল্য আছে। অনেক উন্নতি-অগ্রগতি যেমন দৃশ্যমান, বাংলাদেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি আবার দেশে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটছে, যা আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কোনো দেশের কোনো শাসক দলই সম্ভবত বিতর্কমুক্ত নয়। শাসক দলের সমালোচনা না হওয়াটাই বুঝি অস্বাভাবিক।

তবে এটা একটি ভালো দিক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি সমালোচিত নন। তার উদ্যম-উদ্যোগ, তার পরিশ্রম-নিষ্ঠা সবার নজর কাড়ছে, তিনি প্রশংসিত হচ্ছেন। আবার এটাও ঠিক, তার সরকার, মন্ত্রিপরিষদ সেভাবে মানুষের দৃষ্টি কাড়তে পারছে না। ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি কমছে না। আয় বৈষম্য, ধন বৈষম্য দৃষ্টিকট‚ভাবেই বাড়ছে, যা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।

আগামী নির্বাচনেও জয়ী হয়ে সরকার গঠনের আশা করছে আওয়ামী লীগ। একটু সজাগ হলে, একটু সতর্ক হলে সেটা কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। দল ও সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা, যিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণ এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তার যোগ্য নেতৃত্বে সম্ভাবনাময় এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটছে। বাংলাদেশকে এখন অনেকেই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মনে করেন।

শেখ হাসিনার শক্তির ভিত্তি হতে হবে আওয়ামী লীগকে। দুর্বল আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার পথের সাথী হতে পারবে না। তাই শেখ হাসিনা যেন কোনোভাবেই একা না হয়ে পড়েন, সেজন্য তার রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল শক্তি আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন একটি পুনর্জাগরণ দরকার। দলের মধ্যে একটি পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো দরকার। আবর্জনা পাপোশের নিচে আড়াল না করে ঝেটিয়ে পরিষ্কার করাই শ্রেয়।

ছাত্রলীগের নাম ও পরিচয় দিয়ে দেশে যেসব দুষ্কর্ম চলছে তা বন্ধ করতে হবে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়, এমন সব কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দুর্বলতার শক্তিতে বলীয়ান না হয়ে আওয়ামী লীগকে আত্মশক্তিতে বলবান হয়ে উঠতে হবে। আওয়ামী লীগকে হতে হবে বাঙালি জাতির স্বপ্নের সমান বড়। বিএনপি খারাপ বলে আওয়ামী লীগ ভালো হবে না- এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে হবে।

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

এইচআর/এএসএম