মতামত

মনে একটি অন্তহীন জলসা

গজল সন্ধ্যা- হাল্কা মেজাজের লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই হলো ‘গজল’। এই হাল্কা মেজাজের সন্ধ্যা পার করে এলাম গতকাল। সেই থেকে এখন অবধি একটা ঘোরের মধ্যে আছি যেন। কিছুতেই ঘোর কাটছে না। কানে কেবলি উস্তাদ গুলাম আলী খাঁ সাহেবের মুখ থেকে টুকরো, টুকরো, কথা শুনে, এবং বহু গজলের বাণী ক্ষণে, ক্ষণে বাজতেই থাকে বুকের ভেতরে।

Advertisement

তাঁর কথাগুলোকে ফুলের মালার মতো সুতোয় গেঁথে, যেন গলায় নিয়ে আবেশে হারাচ্ছি। দিন শুরু হয়ে গেছে রাত কেটে, কিন্তু আমার কানে গজল শোনার সুখটুকু কেবলি শুরুই হয়ে আছে শেষ আর হচ্ছে না যেন কিছুতেই। খেই হারিয়ে যাওয়া কথার রেশ ধরে, আবার শুরু করি গজলেরই কথা। অদ্ভুত একটা ঘোর!

আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত খুব পছন্দ করি। এই পছন্দের পাগলামীর সুতো টানতে টানতে আমি যেখানেই ‘ওস্তাদ’ শব্দটা কারও নামের সামনে ঝুলতে দেখতাম সেই রেশ টেনে তাঁকেই ঘাটা শুরু করতাম। এই লিস্টে গতকাল এডেলএইডে পারফর্ম করতে আসা লিজেন্ড গজল গায়ক গোলাম আলীর ভক্ত অনুরাগী হয় উঠি। তার গজল নির্বাচন থেকে মঞ্চ উপস্থাপন সব কিছু মিলায় আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি যখনি তাঁর গজল শুনি।

"ওস্তাদগুলাম আলী (জন্ম: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪০) ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণকারী ও পাতিয়ালা ঘরানার বিখ্যাত পাকিস্তানি গজল গায়ক। ভারতের বিখ্যাত শাস্ত্রীয় গায়ক বড়ে গুলাম আলী খান ও পাকিস্তানের ছোটে গুলাম আলীর সাগরেদ তিনি।"

Advertisement

গুলাম আলীকে না চিনলেও তাঁর গান এক আধ বার শোনার সুযোগ হয়তো হয়েছে অনেকের। তার জনপ্রিয় গজলগুলো হচ্ছে - চুপকে চুপকে রাত দিন, কাল চৌদভিন কি রাত থি, হাঙ্গামা হে কিউ বারপা, কিয়া হায় পেয়ার জিসে, মে নজর সে পি রাহা হা হু, মাস্তানা পিয়ে, ইয়ে দিল ইয়ে পাগল দিল, আপনি ধুন মে রেহতা হু ইত্যাদি।

"তাঁর সম্মাননার ঝুলিতে এযাবত যুক্ত হয়েছে ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যান্স ২০১২ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার লাভ করেন তিনি।২০১৩ সালে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি বড়ে গুলাম আলী খান পুরস্কার লাভ করেন।

গতকালকের গজল মেহফিলের এক একজন সঙ্গতরা ছিলেন অতুলনীয়। এক কথায় অসামান্য। বিশেষ করে তবলা বাদকের বাদ্য শুনে মনে হচ্ছিলো যেন নান্নো সাহাইয়া প্রখ্যাত তবলাবাদকের শিষ্য যেন। তবলার ছাদে আঙ্গুলের নৃত্য গায়কের হারমোনিয়াম আর তবলচির তবলার বোলের রসায়ন ছিল এক কথায় অনবদ্য আবহ তৈরি করেছিল।

গানের সারথীরা প্রাণ পায় সঙ্গতদের সঙ্গ পেয়ে। তাই কাউকে ছাপিয়ে কেউ নয়। শের, নাজম, রাগ, তাল, বাণী, সবকিছুর এক দারুণ সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন গতকালের গজল মাহফিলের সম্রাট গুলাম আলী খাঁ সাহেব তাঁর ছেলে এবং ভারতের পৃথ্বী।

Advertisement

ওস্তাদের গজল, অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যতকালের স্রোতে ভেসে যাবে না, শেষ হয়ে যাবে না। আকর্ষণ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে, হয়তো বা ভবিষ্যতেও থাকবে বলে আমার মনে হয়। গজল মেহ্ফিলে ছিল হাততালির আবেদন, শিল্পীর সাথে শ্রোতাদের গলা মিলিয়ে গানের আব্দার।

অনেকেই আমার আশেপাশেই ছিলেন ভাষা বুঝতে না পারার দরুণ। সন্ন্যাসী রাজা সিনেমার সেই বিখ্যাত গান ‘কাহারবা নয়, দাদরা বাজাও, উল্টো পাল্টা মারছো চাটি, আহ শশীকান্ত, তুমিই দেখছি আসরটাকে করলে মাটি’- টাইপ অবস্থা।

আরেহ ধুর! টাকা নষ্ট! বুড়ো গাইতে পারছে না জমিয়ে গলা ফেটে রক্ত বের হবে এক্ষুণি! হেন তেন ইত্যাদি মন্তব্য আমি একটু আপসেট হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হল ভর্তি লোকের হাল্কা তালি সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাবার একটা মাতলামী দেখে ভালোই লাগছিল।

দরবারি মেহফিলের আবহ না হলেও মঞ্চ, ধ্বনি, আলো ইত্যাদির উন্নত ব্যবস্থা ছিল। গজলের প্রবাদপুরুষ কিছুটা বয়সের ভারে ন্যুজ্ব। হয়তো সময়টা আর নেই গান গেয়ে মঞ্চ কাঁপানোর। কিন্তু তাঁর প্রতি মানুষের ভক্ত অনুরাগীদের যে আকুল ভালোলাগা সেটাই হয়তো তাঁকে এই বয়সে মঞ্চে উঠার সাহস যোগায়।

কেবলি আসর শেষে মনে হয়েছে বলি বেকারার করকে হামে ইয়ু না যাইয়ে আপকো হামারি কসম লট আইয়ে।

বাসায় ফিরলাম গাইতে গাইতে -

হাঙ্গামা হে কিউ বরপা থোরি সি যো পিলি হে ডাকা তো নেহি ডালা চোরি তো নেহি কি হে।

( হৈ হুল্লা কেনো আমাকে ঘিরে, একটু যদি পান করেছি ডাকাতি করিনি কোন আর না আমি চুরি করেছি )।

১৯, ফেব্রুয়ারি ২০২৩লেখক : সাহিত্যিক।

এইচআর/জিকেএস