আইন-আদালত

ব্যাংক-বেকারিতে ‘কর্মব্যস্ত’ ওয়াহিদ ম্যানশন, শেষ হয়নি বিচার

চার বছর আগে এমনই এক বসন্তের রাতে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ওই রাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৬৭ জন মানুষ। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ জনে। ঘটনার পরদিন ওই এলাকার বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলেসহ আটজনের বিচার শুরু হয়েছে। তবে চার বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। রাষ্ট্রপক্ষ চাইছে, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে। তবে আসামিপক্ষ বলছে, তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাবেন।

Advertisement

অন্যদিকে এরইমধ্যে ওয়াহিদ ম্যানশনে সংস্কারকাজ করা হয়েছে। ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় গড়ে উঠেছে ব্যাংক, টেলিকম, বেকারি, কম্পিউটারের দোকান। রীতিমতো কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভবনটি। দিনভর মানুষের পদচারণায় রীতিমতো সরগরম আলোচিত ওয়াহিদ ম্যানশন।

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় চকবাজার মডেল থানায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সুলতান সোহেল ও মোহাম্মদ হাসান সুলতানসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রায় তিন বছর তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক আবদুল কাইউম আট আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪, ৪২৭, ৩৩৬ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

মামলাটি বিচারের জন্য ওই বছরের ২৮ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হয়। চারমাস পর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি আদালত আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন। একইসঙ্গে আট আসামির বিরদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলায় আগামী ১৪ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

Advertisement

আট আসামিই জামিনেমামলায় ভবনের মালিকের দুই ছেলে হাসান ও সোহেলসহ আটজন জামিনে রয়েছেন। তারা সবাই বিচারিক আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। গত ৩১ জানুয়ারি অভিযোগ গঠনের দিন তারা আদালতে হাজিরা দেন। এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য ছয় আসামি রাসায়নিক গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল ইকবাল, ব্যবস্থাপক মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াব আতির, মো. নাবিল ও কাশিফ উদ্দিন জামিনে রয়েছেন।

চালু হয়েছে চুড়িহাট্টার সেই ভবনচার বছর আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ধংসস্তূপে পরিণত হয় পুরো এলাকা। এতে নিহত হন ৭০ জন। আগুনে ভবনটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ভবনটি নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। কয়েকমাস আগে এ ভবনটি ব্যবসায়িক কাজে চালু করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুপুরী চকবাজারের হৃদয়বিদারক দৃশ্য

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের চারতলা ভবনটি নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। ভবনের নিচতলায় বেকারি, কম্পিউটার ও টেলিকমের দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোতলায় তিনটা বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভবন ভাড়া নিয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সংস্কারকাজ চলছে।

Advertisement

অবহেলায় ‘হত্যাকাণ্ড’চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে করা মামলায় আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলায় আসামি মোহাম্মদ হাসান সুলতান ও সুলতান সোহেল অসৎ উদ্দেশ্যে এবং অধিক লাভের বশীভূত হয়ে আসামি ইমতিয়াজকে সঙ্গে আবাসিক বাড়িটি গোডাউন হিসাবে ভাড়া দেন।

অর্থাৎ ভবনের মালিক ও গোডাউন ভাড়াটিয়াদের অবহেলার কারণেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটেছে। আসামি মোজাফফর মানুষের জানমালের ক্ষতি হতে পারে জেনেও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আসামি কাশিফ ও নাবিল গোডাউনের মালিক না হলেও সেলসম্যান হিসেবে ব্যবসা করেছেন। আসামি ইমতিয়াজ পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মূল মালিকের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন।

তবে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ও হাসান সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে দাবি করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মোস্তফা পাঠান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভবন ভাড়া দিয়েছেন। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। আমরা মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাবো।’

আরও পড়ুন >> ফুটেজ বলছে, আগুনের সূত্রপাত সিলিন্ডার: মেয়র

ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মাজহারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন নিহতের ঘটনায় করা মামলায় ৮ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ১৪ মার্চ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়েছে। দ্রুত এ মামলার সাক্ষ্য নিয়ে শেষ করা হবে।

 

কী ঘটেছিল সেদিন২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা। চকবাজার মডেল থানার চুড়িহাট্টা শাহী জামে মসজিদের সামনে রাস্তায় একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের আরেকটি প্রাইভেটকারে আগুন লাগলে সেই গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়। ওইসময় চুড়িহাট্টার নন্দকুমার দত্ত রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে একটি পিকআপ গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওই পিকআপের সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বাড়ির নিচতলা ও রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে।

আরও পড়ুন>> কেমিক্যাল না এলপিজি, ব্লেইম গেম বন্ধ করে প্রতিকার খুঁজতে হবে

মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেটকার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। নিমেষেই চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এ ঘটনায় মোট ৭১ জনের মৃত্যু হয়।

জেএ/এএএইচ/জিকেএস