দেশজুড়ে

যানজট নিরসনে রঙিন স্বপ্ন এখনো সাদাকালো

বগুড়ায় অটোরিকশায় রং করে যানজট নিরসনের প্রস্তাব ঝুলে গেছে। সেইসঙ্গে থেমে গেছে পরীক্ষামূলকভাবে ইজিবাইককে লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াও। স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভার মধ্যে মতানৈক্যের কারণে এই উদ্যোগ সফল হয়নি।

Advertisement

অন্যদিকে, প্রচণ্ড যানজটে শহরে এখন চলাচল করাই দায় হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় মানুষের চেয়ে অটোরিকশার পরিমাণ বেশি দেখা যায়। নিয়ম না মানা, যত্রতত্র পার্কিং ও বেপরোয়া চলাচল এখন বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। শহরকে চলাচল উপযোগী করে গড়ে তোলার এই প্রস্তাবনা এখন দাবি হিসেবে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত উত্থাপিত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতবছরের ১ আগস্ট থেকে বগুড়া শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে দুই রঙের ইজিবাইক চলার কথা ছিল। সিদ্ধান্ত মতো এর আগেই লাল ও সবুজ রঙে শহরে চলা ইজিবাইক বিভক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। একদিন পরপর শহরে আলাদাভাবে লাল এবং সবুজ রঙের ইজিবাইকগুলো চলাচল করার কথা ছিল। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল শহরবাসী। কিন্তু এই উদ্যোগ পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। একইভাবে পরীক্ষামূলকভাবে দুই হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটিও থেমে আছে।

আরও পড়ুন: যানজটে নাকাল ঢাকা, বাড়ছে শারীরিক-মানসিক ভোগান্তি

Advertisement

আরও জানা গেছে, যানজট নিরসনে বিভাগীয় শহর রাজশাহী মহানগরে সকাল ও বিকেল দুইবেলায় দুই রঙের গাড়ি চলাচল করছে। অটোরিকশার মালিক ও চালকদের দেওয়া হয়েছে স্মার্টকার্ড। মাসের প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত মেরুন রঙের অটোরিকশা এবং দুপুর আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হালকা সবুজ রঙের অটোরিকশা চলাচল করে।

এছাড়া মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হালকা সবুজ রঙের এবং দুপুর দুইটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মেরুন রঙের অটোরিকশা চলাচল করে। তবে শুক্রবারসহ সরকারি ছুটির দিনে রাত সাড়ে ১০টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত দুই রঙের অটোরিকশাই চলাচল করতে পারে। অটোরিকশা চলাচল ও যানজট নিয়ন্ত্রণে ‘স্মার্ট অটোরিকশা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর থেকে অনেকটায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে সেখানকার যানজট। দৃষ্টিনন্দন করতে রাজশাহী নগরীতে অটোরিকশা চালকদের নির্ধারিত পোশাকও দেওয়া হয়েছে।

বগুড়াতেও রাজশাহী মহানগরের আদলে একই দিনেই সকাল ও বিকেলে দুই রঙের রিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া গেলে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল।

বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, লাল ও সবুজ রং করে জোড় ও বিজোড় সংখ্যায় দুইভাগে ভাগ করার কথা ছিল ইজিবাইকগুলো। একদিন পরপর ভাগ করে রিকশাগুলো চলাচল করতো। এছাড়া দুই হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। লাইসেন্স পাওয়া এই দুইরঙা ইজিবাইকগুলোই শহরের ভেতরে চলাচল করার অনুমতি পেত। এতে শহরে যানজট কমে যেত। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে নানা কারণে বাস্তবায়ন করা যায়নি।

Advertisement

এ বিষয়ে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, আমরা একদিন পরপর পর্যায়ক্রমে এক হাজার লাল ও এক হাজার সবুজ রঙের ইজিবাইক চলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেইসঙ্গে ফিডার রোডে সীমিত আকারে চিকন চাকার অটোরিকশা চলাচলেরও অনুমতি দেওয়া হতো। বিষয়টি কার্যকর করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সেটি আর হয়নি।

দেখা গেছে, শহরে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও সেটি পরিকল্পিত নয়। অনেক সময় যানজটের চাপে তারাও দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। শহরের মূল পয়েন্ট দিয়ে একটি রেলপথ রয়েছে। এই রেলপথ দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় ১৮ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। প্রতিবার সড়কের সিগন্যালগুলো কমপক্ষে ৩০ মিনিট বন্ধ থাকে।

অর্ধলক্ষাধিক অটোরিকশার অদক্ষ চালকরা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা মানছেন না কোনো ট্রাফিক আইন। যত্রতত্র করছেন পার্কিং। রং সাইড-রাইট সাইড এবং কোনো সিগন্যালের তোয়াক্কা নেই তাদের। মাত্রাতিরিক্ত এসব অবৈধ অটোরিকশা চলাচল শহরে যানজটের বড় একটি কারণ।

এছাড়া যানজটের অপর একটি কারণ ফুটপাত এবং রাস্তার দুইপাশ দখল করে বসানো দোকানপাট আর যত্রতত্র পার্কিং। এর আগে সড়ক প্রশাসন থেকে যানজট নিয়ন্ত্রণে গত বছরের মার্চেই শহরের ভেতর ফুটপাত এবং রাস্তা দখল করে বসা দোকানপাট উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত করার কথা বললেও সেটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পার্কিং নিষেধ সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন: পাড়া-মহল্লার নতুন ‘বিপদ’ ব্যাটারিচালিত রিকশায় হাইড্রোলিক হর্ন

শহরের সাতমাথা, কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক, চাঁদনি বাজার, বড়গোলা, জলেশ্বরীতলা, শেরপুর রোড, গোহাইল রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি সড়কেরই দুইপাশে গড়ে ওঠা দোকানপাটগুলো ফুটপাতের অনেকাংশ জুড়ে তাদের পণ্য রেখেছে। কোথাও ফুটপাতেই বসেছে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট। আবার কোথাও রাস্তার দুইপাশ জুড়ে ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানপাট বসানো হয়েছে। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে ফুটপাতেই সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে জুতা-স্যান্ডেলের দোকান।

দোকানের চাপে বাধ্য হয়েই ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে পথচারীদের। এছাড়া শহরের প্রতিটি সড়কেই অবৈধ পার্কিংয়ের ছড়াছড়ি। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ সব ধরনের যানবাহনের দখলে থাকে শহরের ভেতরের রাস্তাগুলো।

পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কেই আকবরিয়া, শ্যামলী, এশিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি হোটেল থাকায় হোটেলের মালবাহী ভ্যানগাড়ি এবং রেস্টুরেন্টে খেতে আসা ব্যক্তিদের যানবাহনেও যানজটের সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

এছাড়া বাদুরতলা এলাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থাকায় বড় কার্গো গাড়ি সারাদিন ওই এলাকায় প্রবেশ করে। দিনে এই গাড়িগুলোর একটি ওই এলাকায় প্রবেশ করলেই যানজটের সৃষ্টি হয়। যেটি যানজটমুক্ত হতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪০ মিনিট।

একই অবস্থা পার্ক রোডেরও। সরু এই রোডেও একাধিক কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থাকায় দিনে কয়েকবার তাদের বড় আকারের মালবাহী কাভার্ডট্রাক প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার সময় যানজট বেঁধে যায়। যেটি নিরসন হতে সময় লেগে যায় দীর্ঘক্ষণ।

টিনপট্টি এলাকায় দিনে রড, সিমেন্ট এবং টিনের ট্রাক থেকে মাল লোড-আনলোড করা হয়। ওই রাস্তাটি সরু হওয়ায় একটি বড় ট্রাক প্রবেশ করলেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যা নিরসন হতেও সময় লেগে যায় দুই/তিন ঘণ্টা। এভাবে দিনেরবেলা একের পর এক মালবাহী ট্রাক প্রবেশ করায় দিনের পুরোটা সময়ই যানজট লেগে থাকে টিনপট্টি এলাকায়।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বগুড়ার সভাপতি মাছুদার রহমান হেলাল বলেন, শুধু দুই হাজার ইজিবাইকই নয়, আরও ১০ হাজার চিকন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দিয়ে শহরে চলাচলের অনুমতি দেওয়া গেলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। তা না হলে বেকারত্ব বাড়বে।

বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবীর আহমেদ মিঠু বলেন, টাউন সার্ভিস চালুর বিষয়ে তারা সহযোগিতা করবেন। টাউন সার্ভিস হিসেবে হিউম্যান হলার চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই সার্ভিস চালু করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

আরও পড়ুন: ইজিবাইকের দাপট, যানজটে নাকাল গাইবান্ধা শহরবাসী

এ বিষয়ে বগুড়া পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, যানজট নিরসন কল্পে দুই হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। লাল ও সবুজ রঙে বিভক্ত হয়ে শহরে ইজিবাইকগুলো চলানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখন চেষ্টা চলছে পরিকল্পিত উপায়ে যানজট নিরসনে কাজ করার। সেজন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করাসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে বগুড়া সদর ট্রাফিক বিভাগের ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান বলেন, বগুড়া শহরে যানবাহনের ধারণক্ষমতা ২০ হাজার। অথচ সেখানে এর তিনগুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা চেষ্টা করছি। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

এমআরআর/জিকেএস