পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার এক ইউনিয়নেই গড়ে উঠেছে ১৭ ইটভাটা। আর জেলার ৫১টি ভাটার মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র আটটির। আবাদি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর লোকালয়ে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটায় ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জনদুর্ভোগ। বছরে দু একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায় সারছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসন।
Advertisement
সম্প্রতি জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পাশাপাশি দুই ভাটার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী দেলোয়ার হোসেন ও মো. শাহিন। স্থানীয় মাটিয়ারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে আরেকটি ভাটা। এ ইউনিয়নের বিভিন্ন মহল্লায় লোকালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই গড়ে উঠেছে পরিবেশ ধ্বংসকারী এসব ইটভাটা।
আরও পড়ুন: পরিবেশের ছাড়পত্র নেই ফেনীর ৬৮ ইটভাটার
দন্ডপাল ইউনিয়নেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ১৭টি ইটভাটা। তবে এগুলোর কোনোটাতেই কয়লার ব্যবহার নেই। পোড়ানো হচ্ছে কাঠের গুঁড়ি, কাঠ। মাটি উপযোগিতায় দেবীগঞ্জসহ জেলার বোদা ও আটোয়ারী উপজেলায় ভাটার সংখ্যা ৫১টি। এসব ভাটায় টপ সয়েল (মটির উপরিভাগ) বিক্রির যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ৫১টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র আটটির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাত্রপত্র রয়েছে। তবে এগুলোও অবৈধ দাবি স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের।
Advertisement
পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পরিবেশ ছাত্রপত্র পাওয়া আটটি ভাটার বাইরে অন্য সব ভাটায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। চলতি ইট উৎপাদন মৌসুমে এ পর্যন্ত কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে সাত লাখ টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে জরিমানা দিয়ে আবারও সেই অবৈধ কার্যক্রম চালু রাখছেন ভাটামালিকরা।
আরও পড়ুন: দেশে কত নদী আছে, জানালো নদী রক্ষা কমিশন
স্থানীয় মাটিয়াপাড়া এলাকার জয়নাল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাটার জন্য আমরা ঠিকমতো আবাদ করতে পারি না। ক্ষেত-খামারে কাজ করা যায় না। প্রতিবছর বোরো আবাদে সমস্যা হয়।’
দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারি এলাকার হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের যখন বোরো ধান পাকার উপযুক্ত হয় ঠিক তখনি ভাটায় ইট তৈরির কাজও শেষ হয়। সে সময় তারা ভাটার এক ধরনের গ্যাস ছেড়ে দেন। সেই গ্যাসে বোরো ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া এখানে কোনো গাছে ফল হয় না। আমের যে সময় মুকুল ধরে, ভাটার ধোঁয়ায় তাও ঝরে যায়।’
Advertisement
দেবীগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর দন্ডপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যন আজগর আলী জাগো নিউজকে বলেন, “জেলার মধ্যে দন্ডপাল ইউনিয়ন ‘খাদ্য ভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত। এখানকার মাটি বেশ উর্বর। কিন্তু ভাটামালিকদের কূটকৌশলে সেই উর্বর জমির টপ সয়েল চলে যাচ্ছে ভাটায়। তারা স্থানীয় কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে এক ফুট মাটি কাটার কথা বলে কৌশলে দেড় ফুটের বেশি কেটে ফেলেন। তবে আমরা এর যথাসাধ্য প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।”
আরও পড়ুন: যমুনা সার কারখানা যেন দূষণের ‘কারখানা’
এ বিষয়ে দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারি এলাকার ‘এমডি’ ও ‘শাহিন’ ভাটার মালিক মো. শাহিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে প্রায় পাশাপাশি আমার তিনটি ইটভাটা রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য একাধিক আবেদন করা হয়েছে। কিন্ত আমার ভাটা স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে হওয়ায় ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না।’
ভাটায় কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো হয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘স্কুলের কাছ থেকে ভাটার স্থান পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছি। আগামী মৌসুমে নির্দিষ্ট দূরে কোথাও নিয়ে যাবো।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পঞ্চগড় জেলা শাখার আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম খায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলার ৫১টি ইটভাটার মধ্যে যে আটটি ভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে, সেগুলোও পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার মতো না। অবৈধভাবেই তাদের এ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কৃষিজমি নষ্ট করে, বায়ুদূষণ করে, পরিবেশ দূষণ করে যেসব ভাটা করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি।’
তিনি বলেন, ‘এক ইটভাটা থেকে আরেকটির যে মিনিমাম দূরত্ব থাকার কথা, তাও মানা হয়নি। একই এলাকায় পরপর অবৈধ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। স্কুলের ২০ থেকে ৫০০ গজের মধ্যেও ভাটা রয়েছে। এটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।’
এ বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইউসুফ আলী জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ইটভাটা স্থাপন না করলে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। তবে অবৈধ একাধিক ইটভাটায় আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করছি। জরিমানার পাশাপাশি ভাটা বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ধরনের অভিযান চলবে।
এসআর/জেআইএম