ঢাকার প্রধান আলোচ্য ঘটনা এখন কি? আচ্ছা, ঢাকা বাদ দিয়ে বরং পরিসরটা একটু ছোট করি। ঢাকার লেখক, সাহিত্যিক তথা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এখন ‘টক অব দ্য টাউন’ কোনটি?
Advertisement
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি? তুরস্কের ভূমিকম্প? সিরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা? দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া? নতুন রাষ্ট্রপতি? বিএনপির কর্মসূচি? না বন্ধু না। এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো বইমেলায় একজন লেখিকার বই প্রকাশ এবং সেই বইতে ওই লেখিকার শয্যাসঙ্গী হিসেবে কার কার নাম এসেছে, কারটা বাকি আছে সেটা নিয়ে রসালো আলোচনা।
মনে পড়ছে অনেক বছর আগে তসলিমা নাসরীনের ‘ক’ বইটি প্রকাশের পরও এমন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। এবারেও তেমনি। তসলিমা নাসরীনের তবু লেখক হিসেবে কিছুটা পরিচিতি ছিল। এই বইয়ের লেখকের তাও নেই। ভাষা ও ভাবভঙ্গীর দিক থেকেও বইটি মোটামুটি অপাঠ্য।
যা হোক, বইটি প্রকাশের পর পরই এদেশের লেখক সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ লেখিকাকে সাহসী বলে অভিনন্দিত করেন আবার কেউ কেউ এটাকে প্রাইভেসির লঙ্ঘন বলে অভিযোগ তোলেন।
Advertisement
আমি যখন ছোট তখন সাহসী শব্দটির মানে অন্যরকম জানতাম। কেউ দুর্গম পাহাড় চূড়ায় উঠেছেন, কেউ সাগরতলে বৈজ্ঞানিক অভিযানে গেছেন, কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলায় জীবনবাজি রেখে এগিয়ে গেছেন আবার কেউ বৈজ্ঞানিক কোন আবিষ্কার করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আজকাল চলচ্চিত্রে যিনি যত কাপড় খোলেন তিনি ততো ‘সাহসী নায়িকা’ হিসেবে খ্যাতি পান। এই লেখিকাও তার শয্যাসঙ্গীদের বিবরণ দিয়ে সাহসী তকমা পেয়েছেন।
লেখিকা প্রাইভেসির লঙ্ঘন করেছেন বা ‘উচিত কাজ’ করেছেন সেই বিতর্কে আমি যাবো না। কিন্তু তার লেখা পড়ে নিজেকে বড় ‘ব্যাকডেটেড’ বলে মনে হচ্ছে। আমি অনেক বছর ধরেই বিশ্বাস করতাম যে, কোন বিবাহিত নারী/পুরুষের সঙ্গে অন্য মানুষের শারীরিক সম্পর্কে যাওয়া অনৈতিক। ধর্মীয় পাপপুণ্যের কথা এখানে তুলছি না। সেটা তো যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বা অবিশ্বাসের বিষয়। আমি বলছি সাধারণ সামাজিক মূল্যবোধের কথা।
আমার জানা ছিল বিশ্বের সব সমাজেই এ ধরনের একটি সংস্কার বা মূল্যবোধ আছে যে, কোন বিবাহিত নারী বা পুরুষ যদি তার স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে চান তাহলে আগে তাকে বৈবাহিক সম্পর্কটির অবসান ঘটাতে হবে। নিদেন পক্ষে সেপারেটেড থাকতে হবে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকেও এ ধরনের সম্পর্কে যাবার কারণে সমালোচিত হতে হয়েছিল। তারমানে পাশ্চাত্য সমাজেও এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার একটা নৈতিক অপরাধই বটে। এই নৈতিক অপরাধ জেন্ডার নিরপেক্ষ। তার মানে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই এটা অপরাধ।
কিন্তু এই লেখিকার লেখা এবং ফেসবুকে এ সংক্রান্ত আলোচনা পড়ে এখন আমি বুঝতে পারছি আমি খুবই ‘কুসংস্কার আচ্ছন্ন’ একজন মানুষ। সকলের আলোচনা পড়ে মনে হচ্ছে এ ধরনের সম্পর্কে যাওয়াটা একেবারে ডালভাত। এবং লেখিকা খারাপ বলতে যেটা করেছেন সেটা হলো ওই পুরুষসঙ্গীদের এবং সেইসব পুরুষদের নারীসঙ্গীদের নাম প্রকাশ করা। তারমানে নাম প্রকাশ না করে কেউ যদি এ ধরনের সম্পর্কে যান এবং সেকথা বড়গলায় ঘোষণা দেন তাহলে সেটা কোনো অন্যায় তো নয়ই বরং ‘সাহসে’র কাজ। আর যারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের সম্পর্কে যান না তারা ‘ভীতু’।
Advertisement
একটি সমাজের নৈতিকতা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকলে তবেই এ ধরনের চিন্তা সম্ভব। অথবা আমি চূড়ান্ত রকমের ব্যাকডেটেড বলেই এ ধরনের সম্পর্ককে অনৈতিক ভাবছি। এখানে অনেকে জাঁ পল সার্ত্রে এবং সিমোন বোভেয়ারের মুক্ত সম্পর্কের উদাহরণ টেনেছেন। এ প্রসঙ্গে বলি, সার্ত্রে এবং বোভেয়ারের মতো আগে মেধাবী হন তারপর তাদের যৌনজীবনকে অনুসরণ করবেন। পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চাকে নিতে পারবো না বা সেটা নিয়ে ভাববো না শুধু তাদের যৌনজীবনকে অনুকরণ করবো সেটা তো হাস্যকর।
যাক, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। এতবড় একটা বইমেলা চলছে। অসংখ্য বই প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে আলোচনায় আসা উচিত নতুন কি বই লেখা হলো, প্রকাশ হলো সে বিষয়ে। কোন লেখক এবার কত চমৎকার উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখলেন সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
দেশের লেখক, সাহিত্যিক, বিদ্যান সমাজের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত মৌলিক সৃষ্টিকর্ম কারটা কত ভালো হলো সেটা নিয়ে। কিন্তু সেধরনের কোন আলোচনা এখন অবধি চোখে পড়েনি। নিরপেক্ষভাবে তো কেউ আজকাল কিছুই লেখেন না, পড়েনও না। লেখকের সঙ্গে যদি তার জানাশোনা থাকে বা কোন বিনিময়ের ব্যাপার থাকে তাহলেই কেবল তার লেখার প্রশংসা করেন। পুরোটাই পরস্পর পিঠ চুলকানি। তুমি আমাকে ভালো বলো, তাহলে আমিও তোমাকে ভালো বলবো। সমালোচক বা সমালোচনা সাহিত্য আজকাল বিরল প্রজাতি।
এমনকি যারা এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন তাদের লেখালেখি সৃষ্টিকর্ম নিয়েও তেমন কোন গভীর আলোচনা আমার নজরে পড়েনি। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বদলে সকলে যদি ‘কে কার শয্যাসঙ্গী’ আর কার নাম প্রকাশ হয়েছে কারটা বাদ পড়েছে সেসব নিয়ে মত্ত থাকেন তাহলে এদেশের শিল্পসাহিত্যর ভবিষ্যত যে কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য অঙ্গনে আজকাল মেধাচর্চা, জ্ঞানের আলোচনা বড় কম। সবই ফেসবুকীয়, ভাসা ভাসা। অল্প পানির মাছের মতো চলন। সমাজের মাথা হলেন বুদ্ধিজীবীরা। শিল্পী, সাহিত্যিকরা, বিজ্ঞানীরা, চিকিৎসকরা, সাংবাদিকরা। কিন্তু চিংড়িমাছের মাথার ময়লার মতো বুদ্ধিজীবীদেরও যদি পচন ধরে তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকে না।
তবে আমি আশাবাদী মানুষ। তাই আশা করি এ অমানিশা কেটে যাবে। আমাদের শিল্পসাহিত্য জগত আবার জ্ঞানচর্চার আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস