সাহিত্য

মুহূর্তিক ভাবনার হ্যাজাক হাতে মামুন রশীদ

আমিরুল আবেদিন

Advertisement

মামুন রশীদের ঝোঁক আবিষ্কারতুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতির ছাত্র হওয়ায় সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে তত্ত্ব নিয়ে লুফোলুফি করার একটি অভ্যেস গড়ে উঠেছে। একাডেমিক অধ্যয়নের ধারাবাহিকতায় কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম–একজন কবির সঙ্গে কোনো সঙ্গিন মুহূর্তে একজন সমালোচকের সাক্ষাৎ ঘটে এবং সেই কবির মাধ্যমেই একজন সমালোচকের জন্ম হয়। এজন্যই বোধহয় কবির ক্ষমতা নিয়ে এত হইচই। আধুনিক বাংলা কবিতার নান্দনিক বিশ্লেষণই কবিতার আলোচনাকে জিইয়ে রেখেছে–একথা সত্য। তবে তা পাঠকগোষ্ঠী তৈরিতে কোনো কাজে আসেনি। সেজন্যই কবিতা বই আকারে বের হওয়ার এত আকাল। সাহিত্যকে বেগবান করার দায়িত্ব যার ঘাড়ে; সে সমালোচকের মঞ্চ যদি কোনো সাহিত্যকাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তবে সে সাহিত্য অঙ্গন শ্রেণিকরণের মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পথ নেয়। সাহিত্যের ইতিহাস এজন্যই একজন সাধারণ পাঠককে সহজে ঋদ্ধ করতে পারে না।

দেশে সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সময় তত্ত্বের ব্যবহার করতে গেলে কিছুটা বিপত্তি বাধে। অনেকেই মনে করেন কবিতা আসে অবচেতন থেকে স্বতস্ফূর্ত ধারায়। অমন ঝরনাধারার অস্তিত্ব অলৌকিকতার ইঙ্গিতবহ হলেও আধুনিক শব্দটি কবিতার সঙ্গে উপস্থিত থাকায় সে বিষয়টি নাকচ করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে পড়ার সময় ওই বইটিতেই পড়েছিলাম, তত্ত্বের কাজ সাহিত্যকে ভারি করে না। বরং পাঠককে সে কল্পনার অধিভূমির একটি পরিচয় দেয়। কল্পনার মতো আধিভৌতিক জগতের বিষয়টিকে বোঝানোর জন্য কবির সাব্জেক্টিভিটির কলকব্জা খুলে আলাদা আলাদা করে পাঠককে দেখানো–এ দেখো এক আধুনিক মানুষ। এবার কল্পনার রণভূমে বিচরণ করো। তত্ত্বকে নিয়ে লুফোলুফি করার মুহূর্তে বারবার যখন সমালোচক হিসেবে আত্মপ্রকাশের বেদনা জট পাকাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই মুহূর্তিক ভাবনারাজি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন কবি মামুন রশীদ।

যে কবিতাকে দীর্ঘদিন ধরে অনিহায় ছুঁয়ে দেখতাম না, ভাবতাম গদ্যই মূলত সাহিত্যের মুক্তির পথ–সেই আমিও কবিতা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিলাম। আর এই দীর্ঘ নাড়াচাড়ায় আবিষ্কার করলাম কী অদ্ভুতভাবে এই সময়ের প্রাসঙ্গিক এক কবিকে নিয়ে দীর্ঘদিন নান্দনিক মাত্রার আলোচনায় বেঁধে রাখা হয়েছে। কেউ একবারও খেয়াল করলেন না স্মার্টফোন আসার আগের প্রজন্মের তরুণ ও স্মার্টফোন হাতের তরুণ প্রজন্মের কমন অনুভূতির মঞ্চটিকে যিনি প্রতিবার দেখিয়ে চলেছেন অনেকগুলো কবিতায়–সে মামুন রশীদের সহজাত প্রতিভার এই জায়গাটি কেউ দেখতে পাননি। সচরাচর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাংলা কবিতার পাঠকরা কবিদের বিচার করেন দুটো মোটাদাগে। প্রথম দাগ আঁকা হয় কবিকে নানা বিষয়ের লেবেল এঁটে দেওয়ার মাধ্যমে; যেমন নিঃসঙ্গ কবি, প্রেমের কবি, নাগরিক কবি, সময়ের কবি ইত্যাদি। এ দাগটি করা হয় বিষয়ভিত্তিক। এ পদ্ধতিটি সম্ভবত ভুল। দ্বিতীয় দাগটি মূলত কবিতার থিম কিংবা দর্শনকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নানা ইজম ও তত্ত্বের ব্যবহার করে ভারী করে ফেলা হয় এবং সেটাও সমস্যা হতো না যদি গুটিকয়েক কবিকে নিয়ে এত শোরগোল না করা হতো।

Advertisement

ইজম কিংবা নান্দনিক ব্যাখার মাধ্যমে আখেরে তাদের বিশ্লেষণ দাঁড়ায় বিষয়ভিত্তিক লেখার একটি ফর্দ এবং ‘এটি শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠেছে।’ এই আলোচনার বৃত্তে সব কবিকে ফেলে নান্দনিক আলোচনা করলে কবির প্রাসঙ্গিকতা ও মৌলিকতার নজির পাঠকের কাছে থাকবে কী করে? কবি যে অনুভূতির জগত নির্মাণ করেন সে জায়গাই যদি পাঠককে দেখিয়ে দেওয়া না হয়; তখন কবির মাধ্যমে উদ্ভুত কিছু বাইপ্রোডাক্ট যেমন আবৃত্তিশিল্পীরা কবিকে প্রাসঙ্গিক বানানোর ধৃষ্টতা দেখান (এই আলোচনার খাতিরে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কারণ নেই)। তবে মামুন রশীদের কবিতা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সে চিরচেনা পথে আমি যাচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে মামুন রশীদ দাবি করেন, তার অধিকাংশ কবিতাই দুর্বল। বিষয়টি প্রথমে আমি মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমরা দুজনই তার বাক্যগঠন নিয়ে বা দৃশ্যনির্মাণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছি। কিন্তু কবিতা পড়ার অলৌকিক অভিজ্ঞতা থাকে। কারণ কবিতা অনুভূতিকে ধারণ করে। সেজন্য বাস্তবিক জীবনের কোনো অনুভূতি তীব্রভাবে নাড়া দেওয়ার পর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কবিতার লাইন মানুষের সামনে চলে আসে। এমনটা গানের ক্ষেত্রেও ঘটে। বিষণ্নতার সময়ে আচমকাই কিছু গান সামনে চলে আসে যা বুক দুমড়ে-মুচড়ে তার প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করিয়ে দিয়ে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়। সেজন্য তাত্ত্বিকভাবে সমালোচক আগাতে গেলে তাকে অপ্রচলিত পথেই যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। অ্যাকাডেমিয়ার ভাষায় যাকে বলে রিডার্স রেস্পন্স থিওরি। তবে সাধারণ পাঠ-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এই অ্যাপ্রোচকে ভাবার কারণ নেই। একজন সমালোচক যখন রিডার্স রেস্পন্স বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন; তখন তার কাজের বিষয় হয় মানুষ। আর মানুষের প্রসঙ্গের সঙ্গে সময়, সংস্কৃতি, সমাজ এমনকি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানও অর্থবহ হয়ে ওঠে। আর এভাবে ভাবতে গেলেই মূলত একজন কবির প্রাসঙ্গিকতা এবং মৌলিকত্বের রেখাগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পাঠক যখন কবির দৃশ্যকল্পের রেখাগুলো বুঝতে পারবেন, তখন বাস্তবের সঙ্গে কল্পজগতের স্বভূমে তাদের আদান-প্রদান ঘটবে।

দীর্ঘদিন মামুন রশীদ লেখালেখি করছেন। সময়ের নিরীখে তা ২৫ পার হয়েছে (কমবেশি হতেই পারে)। এই দীর্ঘ সময়ে মামুন রশীদ কবিতার জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম। পেশাগত জীবনে স্পন্দন হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতা। কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকে। কবিতার চেয়ে গদ্যই বেশি লিখেছেন একথা হলফ করে বলা যায়। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি লিখে গেছেন পাঠ-প্রতিক্রিয়া। বিশেষত তরুণ কবি-লেখকদের উৎসাহ দেওয়ার নানা স্বাক্ষর রেখেছেন পত্র-পত্রিকায়। তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে। তবে সেসব আলোচনায় মামুন রশীদের প্রতি কবিতাপাঠকের মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ থাকলেও তা একপাক্ষিক, সমালোচনা হতে পারেনি। কারণ সমালোচনার একটি বড় অংশজুড়ে থাকে পাঠককে সচেতন করা। পাঠককে সাহিত্যের দিকে টেনে আনা। হ্যাঁ, অনেক সময় সমালোচকের কড়া বাক্যে অনেক কবিতারই শুধু ছেদ বের হয়। তবে পাঠক এখনো সাহিত্য পড়ার আগে একটু হলেও ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করে। আমাদের দেশে এখনো ভূমিকা কিংবা সমালোচনার ধারাটি সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠেনি। অথবা বলা যায় হারিয়ে গেছে। সে হিসেবে মামুন রশীদকে দুর্ভাগাই বলতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক চলছে। বিগত দশকের বিবেচনায় একশ বছর আগেই জন্ম নিয়েছিল কল্লোল। কল্লোল গোষ্ঠীর জন্ম ও প্রবণতা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কবিতায় কল্লোলের সাফল্য যতটা না অভিনবত্ব ও আধুনিকতার ঝোঁকে তার চেয়ে বেশি কবিতার পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে। ব্যাগে কিংবা হাতে কবিতার বই নিয়ে ঘোরা এবং কোনো বিশেষ মুহূর্তে পাতা উল্টে পড়ার মতো পাঠক তৈরির সুযোগ একবিংশ শতাব্দির তিরিশে ক্ষীণ। বিশ শতকে যখন কল্লোল ক্ষীণ সুযোগের মাধ্যমে একটি পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল, তা মূলত ওই সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক স্তরে পরিবর্তনের জন্যই বেগবান হতে পেরেছিল। তবে ক্ষীণ সুযোগকে ব্যবহারের চেষ্টা তারা করেছেন এবং আলোচনায় অভিনবত্ব এনেছেন। একবিংশ শতাব্দির তিরিশে এসেও মামুন রশীদকে বিচার করতে গেলে দায় আলোচকদের ঘাড়েই বর্তায়। এত এত আলোচনার পরও পাঠককে টানতে না পারার। কবির আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে তিনি বিচরণ করলেন গদ্যের জগতে। কবিতা নিয়ে ভাবার, শব্দশয্যায় গা এলিয়ে দেওয়ার বিষয়েও বোধহয় তিনি কিছু করতে পারেননি। একে আমরা নিঃসঙ্গতা বলতে পারি না। বলতে হবে বিচ্ছিন্নতা। তিনি যেন নিজের উপস্থিতি ঘোষণার ক্ষেত্রে বড্ড মুখচোরা। কারণ কবি মামুন রশীদের কবিতা একটি নির্দিষ্ট বয়সের পাঠকদের জগতকে তুলে ধরে। একজন কবিকে সর্বজনীন হতে হবে এমন নয়। তার শক্তিমত্তা সুক্ষ্ম জগতেও হতে পারে। অদ্ভুত বিষয় হলো, এই দীর্ঘ সময়ে কেউ কি এই বিষয়টি আদৌ খেয়াল করেননি? মামুন রশীদ দুটো প্রজন্মের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন তার কবিতার মাধ্যমে। তিনি সেই সাধারণ কল্পক্ষেত্র নির্মাণ করেন কবিতায়, যা স্মার্টফোনের সাক্ষাৎ না পাওয়া তরুণ প্রজন্ম এবং স্মার্টফোন পাওয়া আধুনিক দিশেহারা প্রজন্মের অনুভূতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মিলগুলো দেখিয়েছেন। যে কোনো পাঠক তার কবিতার মাধ্যমে এই আধুনিক সমাজের তরুণদের ঝোঁক আবিষ্কার করতে পারবেন। তবে তারা দেখবেন, মামুন রশীদ সুন্দর ভঙ্গিমার মাধ্যমে কালবেলার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

একটি অভিজ্ঞতার আলোকে মামুন রশীদের কবিতাঅফিস শেষে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বাসায় ছুট দেওয়ার মুহূর্তে বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফেরার সময়টায় যতটুকুই সুযোগ পাওয়া যায়, বাসের জানালার ফাঁক দিয়ে অনেক সময় ক্লান্ত চোখ আকাশে তাকাবার সামান্য সুযোগ পায়। তখন একটা চাঁদ চোখে পড়ে। শহুরে জীবনে অলৌকিক না হলেও একে মানুষ অনুভব করারই সুযোগ পায় না। আবার এই দৃশ্যে বাসের সঙ্গে ক্রমেই এগিয়ে চলা চাঁদটাকে নিয়ে কোনোকিছু ভাবার আগে বাড়ি ফেরার তাগাদা আর একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে অভিকর্ষজ টান–সবদিকের চাপে ক্লান্তির পারদ ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাড়ি ফেরার পর হয়তো আপনি একটু স্বস্তি নিয়ে শুয়ে পড়বেন। হাত বাড়িয়ে খুঁজবেন একটা বিস্ফোরণ, যার জন্ম হয়েছে একটা শূন্যতা থেকে যা বুক ঝাঁঝড়া করে দিতে চায় তবু বের হতে পারে না। ঠিক এমন মুহূর্তের জন্যই বোধহয় কবিতার জন্ম হয়। জন্ম নেয় কবিতার পাঠক। এজন্যই বোধহয় একসময় কবিতার বই বুকে করে ঘুরতে বলার আকাঙ্ক্ষার কথা বারবার শোনা গেছে। মানুষ বাঁচে মুহূর্তের মধ্যে। আর এই মুহূর্তকে গুচ্ছবদ্ধ ধারণার মতো প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকতে চাই কবির। কিছু কিছু বিরল কবি মুহূর্তিক ভাবনারাজি নিয়ে কাজ করেন। জীবনানন্দ দাশের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল। তার মানে এই নয় মামুন রশীদ ও জীবনানন্দ একই ধাঁচের কবি। বোঝার স্বার্থে বিষয়টি টেনে আনা। কারণ কবির কাজের মঞ্চ শব্দকে ঘিরে। কিন্তু শব্দ যে বিরাট জগতের অংশীজন সে ভাষার রূপতত্ত্ব নিয়ে মাথা পাঠক না ঘামালেও কবিকে অবচেতনে ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে উঠতে হয়। একটু আগে বলা অভিজ্ঞতায় পাঠক খেয়াল করবেন, এই দীর্ঘ যাত্রায় চাঁদ শহুরে অস্তিত্বের সঙ্গেই ছিল। তবু চাঁদে অলক্ষ্যে চাওয়া শহুরে মন মুহূর্তিক ভাবনায় নিমজ্জিত। এই অস্থির মন এক অসম্ভব উপসংহারে পৌঁছাতে চায়। বুকভর্তি শূন্যতার মধ্যে আমরা সবাই যখন ইট হয়ে বাঁচি তখন চাঁদের দিকে চোখ ফিরিয়ে মামুন রশীদ বলেন: মধ্যরাতে কানখাড়া করে জানালার গ্রিল থেকে দূরের চাঁদটার দিকে তাকালে টের পাবেন জুলেখার সখীরা কি করে কেটেফেলেছিল হাতের আঙুল?(বিভ্রম)

Advertisement

কবিতার নাম ‘বিভ্রম’। সত্যিই বিভ্রম জাগায়। এই কবিতায় কবির উপস্থিতি নেই। একটা প্রশ্ন যেটি মুহূর্তের জন্য আমাদের মাথায় কাজ করবে; সেজন্য মামুন রশীদ নিজের অস্তিত্ব মিলিয়ে দিয়ে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন এই মঞ্চে। দূরের চাঁদের দিকে যিনি তাকাবেন তিনি কি নারী না পুরুষ? জুলেখার হাতের আঙুল কাটার মতো বিভ্রমটিই বা কি? এখানেই মামুন রশীদের হ্যাজাকবাতি আমাদের পথ দেখায়। মুহূর্তিক এই ভাবনা আমাদের সাব্জেক্টিভিটিকে আরও স্পস্ট করে তোলে।

ভীষণভাবে শহুরে কবি মামুন রশীদমামুন রশীদের অধিকাংশ কবিতাই মূলত শহুরে জীবনগাঁথার দৃশ্য তুলে আনে। তবে এই কবিতা তরুণ বয়সের অনুভূতিতে সরেস। বিশ থেকে তিরিশোর্ধ্ব যুবকের অপরিণত মনের বিরাট অংশজুড়ে থাকে একটি ভাবনা–প্রেম। প্রেমের রকমফের রয়েছে। মামুন রশীদও প্রেমকে উপজীব্য করে কবিতা লিখেছেন। তবে সেটি উদ্দেশ্যবিহীন একক প্রেমিকের অনুভূতি হিসেবে আমার কাছে ধরা পড়েনি। এটি আমার কাছে মনে হওয়ার পেছনে দীর্ঘদিন অ্যাকাডেমিয়ায় কালচারাল স্ট্যাডিজ ও তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বের প্রক্রিয়া পড়ার কিছুটা প্রভাব তো রয়েছেই। যা হোক, মামুন রশীদ প্রেমের কবিতা লিখেছেন কিন্তু তিনি কবিতায় প্রজন্মের সাধারণ প্রবণতাকেও ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্তু তিনি চেনা রুট নেননি। এই বিষয়টি অদ্ভুত। আধুনিক প্রজন্মের চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কবিরা অশুভের পথ নেন। এই প্রজন্মের বিষণ্নতা, গ্লানি, সুযোগের অভাবে সৃষ্ট শূন্যতা ও প্রেমহীনতাকে উপজীব্য করে তরুণদের তুলে ধরার চেষ্টা অধিকাংশ কবিই করেছেন। আমাদের এই সময়ে বেঁচে থাকা সব গুরুত্বপূর্ণ কবিই কাজটি করেছেন। অনেকটা বোদলেয়ারের মতো অশুভের পথ ধরে শুভ ইঙ্গিত দেওয়ার। কিন্তু সে কাজটিও তো তারা করেননি। বরং আমার মনে হয়েছে তরুণ প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তারা যেন নিজের দশকেই আটকে রয়েছেন। এখন শুধু সেই সময়ে আটকে থেকে বর্তমানে বসে নিরর্থক ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। এখানেই মামুন রশীদ তার রুটটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তার কবিতায় বর্তমান প্রজন্মের অনুভূতি তুলে ধরেন। কিন্তু এই কাজটি তিনি ইতিবাচক ভাষায় করেন বলে চোখে ধরা পড়ে না। বিভ্রম কবিতাটি এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই কবিতাটি সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা এই প্রজন্মের তরুণ যুবার অহংবোধ সহজেই অনুভব করবো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে যতটা না চাঁদ দেখে মুগ্ধ, তারচেয়ে বেশি চিন্তিত তাকে নিয়ে কোন তরুণী স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে। এই বিভ্রমে আটকে থাকা তরুণ কিংবা যুবাদের কথাই মামুন রশীদ ভেবে বলেছিলেন কি না তা জানা নেই। তবে আমরা যখন নিজেরা একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাই; তখন সমাজের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাইন ঠিকই আবিষ্কার করি। কারণ সসুর তো ভাষাকে এই সাইনের সমাহার হিসেবেই দেখিয়েছেন। আর ভাষার কারিগর কবি এই সমাহারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেন না। সংস্কৃতি তার সাব্জেক্টিভিটিকে নিয়ন্ত্রণ করবেই।

বিভ্রম কবিতায় শহুরে জীবনের ক্ষুদ্র মুহূর্তের একটি দৃশ্যই তুলে ধরা হয়েছে। আর পাঠক কবিতাটি পড়ার পর এক ধরনের মানসিক বিস্ফোরণের মুখোমুখি হবেন। মামুন রশীদকে আমরা শ্রেণিকরণ বা বিষয়ভিত্তিকভাবে লেবেল সেটে দিতে পারছি না। কারণ তিনি যে প্রেম, সমাজ, অনুভূতির গল্প বলছেন তার শ্রেণি, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, বয়স এমনকি সময় একেবারেই আলাদা। তার কবিতার প্রেক্ষাপট শহর। শহরের জীবনে প্রেমের রূপটি আমাদের সবারই জানা। এখানে একজন তরুণের প্রেমিকা না থেকেও সে প্রেমে পড়তে পারে। কাল্পনিক প্রেমিকার ভাবনায় বিভোর তরুণের ভেতর শূন্যতার বোধ থেকে সে কিছু মুহূর্তিক ভাবনা মস্তিষ্কে সেঁটে নেয়। বিভ্রম কবিতাটি মূলত এমন প্রেমের কথাই বলছে। জানালার ওপাশে মধ্যরাতে কানখাড়া করে রাখা ব্যক্তিটি নিজেকে চাঁদের সমান্তরে মিথিক্যাল সেই সুদর্শনের অবস্থানে রেখে দিয়েছে। মজার বিষয় হলো, মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মামুন রশীদ সচেতনভাবেই ইউসুফ-জুলেখাকে টেনেছেন। তিনি চাইলে অন্য উদাহরণও টেনে আনতে পারতেন। কিন্তু তেমনটা হলে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান ও আবিদ আজাদের কবিতার সঙ্গে তার কবিতার তুলনা করে বসতে হতো। মুহূর্তিক ভাবনারাজির ব্যবহারের সময়েও মামুন রশীদ যে সতর্কতার পরিচয় ও মৌলিকত্ব দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পুরো কবিতার বইয়ে এই একটি কবিতা পাঠককে বারবার ভাবাতে বাধ্য করবে। রহস্যটির সমাধান যেন করতেই হবে। কে মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে? কবিতাটি সহজ ও সরল প্রেক্ষাপটে অবস্থান করলেও আধুনিক নাগরিক জীবনে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার চিত্রই তুলে ধরে। সামান্য একটা ইট হয়ে বেঁচে থাকার নাম জীবন হলে সে কবিতার লাইনেও দুর্বল প্রকাশভঙ্গি আসবে।

মামুন রশীদ তরুণ প্রজন্মের জন্যই কবিতা লিখেছেন। যেমন তার ‘অভিশাপ’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক: আমিও মাটি খুঁড়তে খুড়তে, লুকিয়ে পড়তে পড়তে কিন্তু এ কি? বেরিয়ে পড়েছে শরীর, পায়ের শেকল, চারদিকে চিৎকার, উল্লাস, পুলকিত হাসিআমিও টোপ হয়ে বড়শিতে গেঁথে নিষ্পলক অপেক্ষায়কখন জলের অতল থেকে গিলে নেমে মৃত্যু। (অভিশাপ)এই কবিতাটি কেমন পাঠকের অনুভূতি তুলে ধরে? বা পড়লে আমাদের সমাজের বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে কেমন দৃশ্য ভাসিয়ে তোলে? তিরিশোর্ধ্ব কোনো যুবক যার জীবনের বিশাল একটি অংশ পার হয়ে গেছে। সে স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে তার বিগত জীবনের শেকলবদ্ধ অবস্থাই তার কাছে এই বয়সে স্পস্ট হয়ে ধরা দেয়। অথচ নগরে কোলাহল বেড়েই চলেছে। আরও ঘিঞ্জি হতে শুরু করেছে। আর সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি একটি বয়সে নিজেকে চেনার সুযোগ পায়। তখন সে বুঝতে পারে, সে টোপটি গিলেই ফেলেছে বহু আগে। এখন শুধু প্রতীক্ষা এই জীবনটি কোনোমতে পার করে দেওয়ার। অন্তত এমন একটি দৃশ্য আধুনিক বিষণ্ন ও সমাজবিচ্ছিন্ন তরুণ প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

প্রেমের ক্ষেত্রে মামুন রশীদ প্রবলভাবে শহর সচেতন। সেখানে গ্রামীণ বিস্তৃতির প্রভাবপ্রসূত মেলোড্রামা কিংবা আবেগের আতিশয্য তিনি রাখেননি। তাই প্রেমের প্রসঙ্গেও ওই যান্ত্রিক বিষণ্নতা তিনি রেখেছেন। আবার ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত কামনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি মামুন রশীদ সচেতনভাবে করেছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও একজন পাঠক হিসেবে আমরা এই বিশ্লেষণের স্বাধীনতা নিতেই পারি। যেমন প্রেম কবিতার কয়েকটি লাইন এমন–মুখ গুঁজে থাকা শামুক, তোমাকে দেখার পর জেগে উঠেনিরুত্তাপ ছায়ার ভেতর পথ খুঁজতে থাকে আলোকরশ্মি। যেন উষ্ণ হতে হতে, পত্রহীনহতে হতে, পা ফসকে না যায়। (প্রেম)

প্রেমিকাকে দেখার পর জৈবিক তাড়না কিংবা কামনার সহজাত বিষয়টিও নির্দ্বিধায় মামুন রশীদ তুলে এনেছেন। খুব সামান্য একটি থিম–প্রেম। কিন্তু প্রেম সব সময় শাশ্বত নয়। সেখানে কামনার বিষয়টি থাকে। সমাজ গঠনের পর প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিগত তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্যাবু নির্ধারণ করে সমাজ। তবে প্রবৃত্তিকে সামাজিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে বা গোপনে রাখার নিয়ম ও সামাজিক একাত্মতা প্রত্যেকের মধ্যে থাকলেও এই কামনা ও প্রবৃত্তিগত তাড়না অন্য কোনো রূপে সমাজে চলে আসে। সেটি প্রেমের খোলসেও আসতে পারে। প্রেমিকাকে কামনা করা এবং তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উত্তেজনাকর মুহূর্তকেও কি অস্বাভাবিক মনে হয়? তবে তিনি সাবধান বাণীও দিয়েছেন। প্রেমিকাকে কামনা ও সে কামনার নিবারণের জন্য প্রেমের ফর্মালিটির মধ্য দিয়ে তাকে যেতেই হয়। ফলে একসময় পা ফসকে তা অপূর্ণ থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়। মামুন রশীদের এই কবিতাটি যেন সে কথাই আমাদের দেখিয়ে দেয়। তিনি পাঠককে মঞ্চ দেন। পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন। এই যে অশুভের বা নেতিবাচক একটি ভাবনাকে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন তা কেন? কারণ তার কবিতায় তিনি পাঠককে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দেন। এজন্যই এমন যৌনতাড়িত ভাবনাও তার কাছে সঠিকই মনে হয়। বিষয়টি পাঠ-প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টিতে একবার ভেবে দেখুন পাঠক। আপনারাও সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন।

মামুন রশীদ শহরের বন্দি জীবন সম্পর্কে সচেতন একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তার অধিকাংশ কবিতায় শহরের অনুভূতি প্রবল। তবে তিনি নাগরিক জীবন নয়, তরুণদের নিঃসঙ্গ বা শূন্যতার বোধকে তুলে আনেন। তিনি সেসব তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করেন যে তরুণরা জীবনযাত্রার কোনো পথেই আশার আলো দেখেন না। পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের মনে প্রেম ও প্রেমের সম্ভাবনা বিরাজ করে। প্রেমের স্বরূপ সম্পর্কে তাদের সামান্য ধারণা যে নেই সেজন্যই মামুন রশীদ বলে বসেন–খাঁচা আর মুক্তাকাশ যে অশ্লীল পার্থক্যেগলি-অলিতে স্লোগান আঁকে বিভেদের দেয়ালে,তাকে পরিত্যাগ করা এত সহজ?(মুক্তি)

এখানে পাঠক হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক ঘ্রাণ পান। তবে সমাজের প্রতিটি মানুষই রাজনৈতিক। তবে এই কবিতাটি রাজনৈতিক ঘ্রাণের আলখাল্লায় এক বিষণ্ন ক্রোধের চিত্র তুলে ধরে। এই নিঃসঙ্গ শহুরে বিচ্ছিন্নতায় এক তরুণের পক্ষে উদ্দেশ্যহীন হাঁটা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তবু এই না পাওয়ার অতৃপ্তি থেকে তার মুক্তি যে ঢের দূরের বিষয়, তা অনুভব করে তাকে বাড়ি ফিরতেই হয়।

মামুন রশীদের কাছে প্রেম কামনা ও যৌনতা বিবর্জিত নয়। বিষয়টির জন্যই তাকে সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ কবি বলতে হচ্ছে। কারণ হঠাৎ দেখে কবিতায় তিনি বলছেন–আপেল চিরকাল বিবাদী ফল। দুলুক পেন্ডুলামের মতো। লোভী তার কমনীয় ত্বক ও রসে।

এই কবিতার যৌন ঘ্রাণটুকু অস্বাভাবিক নয়। এখানেও তিনি মিথের ব্যবহার করেছেন। তবে এবার আপেলকে বিবাদী বলা হয় শুধু সাংসারিক জীবনের ধকলে ব্যক্তি তার সাব্জেক্টিভিটি নিয়ে যখন সংশয়ে ভোগেন। এই বয়সেও তার কামনা সেই আগের মতোই থাকে। তবু বয়সের একেকটি স্তরে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিয়ম সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। সেজন্য নারীস্তন কিংবা যৌনতা মানসিক বিবাদের জালে ব্যক্তির অস্তিত্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে রাখে। এই যে সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মামুন রশীদকে দেখা তা এই সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক তা আমার প্রতিক্রিয়া থেকেই হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন।

তবে মামুন রশীদ এই সামান্য বিষয় নিয়েই লিখেছেন তা কিন্তু নয়। সময় যত গেছে মামুন রশীদের কবিতা একটি মৌলিক পরিণয়ের দিকে এগিয়েছে। তার কবিতা চেনা কোনো ঝোঁকের হাতেই ধরা দেয়নি। একটি বিশেষ সময়ে নানা মেজাজের ছবি তিনি এঁকেছেন। তার চিন্তাপ্রক্রিয়ার বিশাল একটা অংশজুড়ে থাকে লেখালেখি এটুকু অনুমান করা যায়। সংবাদপত্রে গদ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি যে গদ্যসুলভ কিছু কবিতা লিখে ফেলেন, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে। তার ‘যা কিছু লিখেছি সব সব প্রেমের কবিতা’ বইয়ে দু’ লাইনের একটি কবিতা রয়েছে–প্রহর চলে গেলে, চুপচাপ মহিষের ঘাড়ের চিহ্ন আঁকা পথেআগামীর সম্ভাবনায় ক্রমশ নম্র হয়ে আসে উৎসবমুখর পাখিরা।

দুই লাইনের কবিতা হলেও এই কবিতায় গদ্যের ঘ্রাণ এড়ানোর অবকাশ নেই। যেন একটা গল্পের লাইন শুরু করেই খান্তি দিলেন। এখানেও তিনি মুহূর্তের একটি ভাবনা যা ক্ষণস্থায়ী তাকে উপজীব্য করলেন। এমন অনেক গদ্যসুলভ কবিতা তার রয়েছে। তবে এদের দুর্বল বলাটা ঠিক হবে না। বাস্তবজগতে গল্পের প্রেক্ষাপটেও কবিত্বের জন্ম হতে পারে। তবে আমার ধারণা এই কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে মামুন রশীদ আরেকটু পরিশ্রম করতে পারতেন। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন বরাবর, কবিতায় তিনি সময় কম দিয়েছেন। যা হোক, সব কবিই মূলত মুহূর্তের ভাবনাকে আবদ্ধ করেন। তবে তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই সে কবিতাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে টেনে আনার প্রবণতা থাকে। অথচ মামুন রশীদ অতটা পরিশ্রমের পথেই আগাননি। তিনি সচেতনভাবে পাঠককে লেন্সটি পড়িয়ে দেন–তুমি আমার, এর বেশি লিখতে থেমে যায় কলমপাতার ফাঁক গলে, পথে করে দিচ্ছে সবুজ আলো।আমি লিখতে পারছি না, আমি ঘুমাতে পারছি না।

প্রথম শব্দটিই মূলত তার কবিতার সব প্রেক্ষাপটকে ছুঁয়ে যায়। সব প্রেমের যে শাশ্বত চাহিদা-তুমি আমার। এমন প্রাসঙ্গিক এক কবির কবিতা কেন এখনো পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। মামুন রশীদ প্রজন্মের গল্প বললেও নিজের শেকড় ভোলেননি। তিনি তার সময়ের স্মার্টফোনহীন সময়ের নানা চিত্রও তুলে এনেছেন। তিনি প্রবলভাবে পূর্বজ কবিদের কবিতা সম্পর্কে সচেতন। তার কবিতায় ভূগোল ও ইতিহাসের ঠাঁই ও আছে। পদ্মা নদীকে নিয়ে তিনি যখন লেখেন–তপস্যার বৃষ্টি নামে? বলো বিষ্ণুপদীবলো তারার আগুনে ফোটা বসন্তের ফুল।

এই যে তাকে চেনা ঝোঁকে কিছুক্ষণ আগেও বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম; সেখানেও তিনি বাঁধ সাধলেন। দেখালেন তিনি প্রবলভাবে ইতিহাস সচেতন। তার নির্মাণে তিনি স্বাভাবিকভাবে তা তুলে আনেন। পাঠককে ঠেলে দেন ইতিহাস জানার পথে। কারণ ওই ইতিহাস না জানলে এই কবিতা বোঝা যায় কি? এজন্যই শিরোনামে বলা, মুহূর্তিক ভাবনার হ্যাজাক জ্বেলে মামুন রশীদ পথ দেখান। আর কবিতায় তিনি ভূগোল ও রূপক ব্যবহারে পূর্ববর্তী প্রজন্মের ভাবনাকে আনেন। তার ‘শিউলি’ কবিতায় যেমন বলেন–কেউ জানে না, তবু কি অবাকভাবে ফুজিয়ামার আঁচফিরিয়ে দিচ্ছে উদিত সূর্যের হাতছানি। নখদর্পণে রাখাসিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে আপিলের রায়ে।

এই কবিতায় ফুজিয়ামার আঁচের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে বোধহয় একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে ফুজিয়ামার তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে। তবে পুরো কবিতার ভার যেন ফুজিয়ামা শব্দের মাধ্যমে সমানভাবে বণ্টন করা হয়ে যায়। ফুজিয়ামা কেউ চোখে দেখুক বা না দেখুক, এই শব্দটি বর্তমানেও যে কোনো পাঠককে নাড়া দিতে সক্ষম। এই যে আদ্যন্ত সচেতন প্রেম ও অপ্রেমের কবিতার মধ্যে ঘুরপাক খান মামুন রশীদ তা অসংখ্য গল্প বলে। সেই গল্পে সমাজ, সাংস্কৃতিক উপাদান-বুনিয়াদ কী চমৎকারভাবে উপস্থিত। তার শহুরে শিক্ষিত কবিতা জীবনানন্দ বা আধুনিক অন্য কবির মতো অন্ধকারের না। জীবনানন্দের পরিচয় অন্ধকারে। আধুনিক অধিকাংশ কবিই অন্ধকারের পথ ধরেছেন। মামুন রশীদ সূর্যালোকে ছায়ার দিকে তাকিয়ে কবিতার দৃশ্য বানান। ছায়া কিছুক্ষণ পর মিলিয়ে যাবে এবং দু’জনার কথা বলার ফুরসত থাকবে খুব কম। সেজন্য মামুন রশীদ একটি হ্যাজাক জ্বালিয়ে নেন ছায়াটি ধরে রাখার জন্য। কবিতার ভেতর মুহূর্তিক ভাবনা থিম হিসেবে রেখে তিনি কবিতাটিকে চালান। আর পাঠককে অমোঘ আকর্ষণে উপস্থাপন করেন কবিতার মধ্যে। অথচ মামুন রশীদ এখনো পাঠকের কাছে অনাবিষ্কৃত। অন্তত সেই তরুণ হতাশ প্রজন্ম যারা কিছুটা হলেও নিজের অস্তিত্বকে ভালোভাবে দেখার লেন্স পাবে, তাদের কাছে মামুন রশীদকে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। একইসঙ্গে এক অদ্ভুত লোভ জেগে থাকে, তিরিশের দশকেও এমন প্রাণবন্ত তরুণ মন নিয়ে থাকা মামুন রশীদ সামনে কেমন থিম বা দর্শনকে ধারণ করবেন। কারণ তিনি তার কবিতায় বরাবরই নিজেকে অনুপস্থিত রাখেন। এমন ক্ষমতা খুব কম কবিরই থাকে। আধুনিক কবি পাঠকের জন্ম দেন নিজের মৃত্যু ঘটিয়ে। রোলা বার্থের এই কথাটি কি তিনি মনে রেখেছেন? তাহলে আশা করাই যায়, সামনে পাঠকের সামনে তিনি অভিনব রূপেই আসবেন প্রতিবার। পাঠকের কাছে যেন তিনি পৌঁছান সেজন্য তাকে নিয়ে আলোচনার দায়টি আমাদের রাখতে হবে।

এসইউ/এএসএম