রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের আচরণ ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধ শিক্ষার্থী নির্যাতন, হুমকি, ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়াসহ পাহাড় সমান অভিযোগ আছে। এমনকি ছাত্রলীগের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেকে বাদ যাচ্ছেন না হল প্রাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে গত দুবছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া ভয়ে প্রশাসনের অভিযোগ দেননি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও শতাধিক। দেওয়া অভিযোগের মধ্যে ১৩টির তদন্ত কমিটি হয়েছে। এরমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ছয়টির।
অভিযোগ আছে, কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন। দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও তা ছিল লোক দেখানো। শিক্ষকরা মনে করছেন, এসব ঘটনায় শাস্তি না হওয়ায় আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য কমছে না।
আরও পড়ুন: ‘লাশও তোর পরিবার খুঁজে পাবে না’ ছাত্রলীগ নেতার হুমকি
Advertisement
সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে কৃষ্ণ রায় নামে এক ছাত্রকে শিবির ট্যাগ দিয়ে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন তিনি।
এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুরের অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ধাওয়া দিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৌমিক ও আতিক নামে দুই ছাত্রলীগকর্মীকে আটকের পর বিভাগ কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
এ সময় প্রক্টরিয়াল বডির দুজন সদস্য, মতিহার থানার দুজন উপ-পরিদর্শক (এসআই), সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ফোকলোর বিভাগের সভাপতি এবং শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিলেন। এ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করে ছাত্রলীগের সভাপতি ওই দুজনকে নিয়ে যান।
হল থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রলীগ শুরুতে আসন দখল করতে আবাসিক হলের কক্ষগুলোয় তালা মারতে শুরু করে। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করে। ২০২১ ও ২০২২ সালে ২৩ শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। এমন ঘটনাকে ঘিরে হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও আছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।
Advertisement
আরও পড়ুন: রাবি ছাত্রলীগের ২ নেতার দলীয় পদ স্থগিত, দুজনকে শোকজ
পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছর উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ১ জুলাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে অবৈধদের বের করে দিয়ে রাতভর বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হয়। এদের মধ্যে ২০ শিক্ষার্থী এখনো হলেই আছেন। এরপর হলের সিট দখলের দৌরাত্ম্য কমতে থাকে। তবে বৃহস্পতিবার হলে আটকে নির্যাতনের খবর পাওয়া গেলো।
আগের কিছু ঘটনা
গত বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়।
এরপর মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন ক্যাম্পাস ছাড়েন। তিনি গত বছরের ২৬ আগস্ট কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রক্টরের দপ্তরে একটি অভিযোগপত্র পাঠান। আল-আমিনকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়।
আল-আমিনের অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তার ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নেন।
গত বছরের ১৯ আগস্ট মতিহার হলে চাঁদা না দেওয়ায় অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। হলকক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে মারধর করা হয়। হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে’।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি রাতে শাহ মাখদুম হলের ২১৪ নম্বর কক্ষে সামিউল ইসলাম নামের এক আবাসিক ছাত্রকে মারধরের পর মানিব্যাগ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে ওই হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান অপূর্বের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে কাউকে বললে প্রাণনাশের হুমকিও দেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী সামিউল।
২২ জানুয়ারি দিনগত রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বিছানাপত্রসহ মো. জাকির হোসেন নামে এক ছাত্রকে নামিয়ে দেন ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিন ইসলাম ও তার কর্মীরা। পরে সেই সিটে আরেকজনকে তুলে দেন মোমিন। বিষয়টি একাধিকবার হল প্রাধ্যক্ষকে জানালেও সমাধান না পেয়ে বিছানাপত্র নিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন ওই ছাত্র।
তদন্ত কমিটির ‘অবহেলা’
হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মারধরের মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও কোনোটির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ওপরের ঘটনাগুলোর দ্রুতই তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু একটিও প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, করোনার পর অন্তত ২৩টি ঘটনায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর দপ্তর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সূত্র বলছে, এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে একটি ঘটনায়ও ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারিত্ব, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশনেও বসেছেন তিনি। গত বছরের ২৬ জুন তিনি প্রশাসন ভবনের সামনে শামসুজ্জোহা চত্বরে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেরাও ভাবছি। তাদের এমন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে আমরা অসহায় অনুভব করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্রলীগের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতাশাজনক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে এগুলো আরও বেপরোয়া হচ্ছে।’
ফরিদ উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমরা ভাবছিলাম বিষয়গুলোতে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাবে। এখন দেখছি তারা ছাত্রলীগের মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে। কোনো অপকর্মের পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। সামনে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হকের দাবি, ‘অনেকগুলো বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছি। সেগুলো শিগগির ডিসিপ্লিন কমিটিতে যাবে। এরমধ্যে অনেকেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’
তবে তিনিও মনে করেন, ‘শাস্তি হলে হলগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবগুলো ঘটনার সত্যতা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেসব ঘটনার সত্যতা পেয়েছে সেগুলোর বিচারও হয়েছে।’
আরও পড়ুন: সাইকেল চুরির অভিযোগে হল থেকে ছাত্রলীগ নেতা বহিষ্কার
তার দাবি, ‘১২ ফেব্রুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের কৃষ্ণ রায়ের ঘটনা সত্য নয়। সেখানে আমাদের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী ছিল। সে বাড়ি যাওয়ার কারণে একজন অনাবাসিক শিক্ষার্থী উঠেছিল। এ নিয়ে ছাত্রলীগের যারা নেতৃবৃন্দ ছিল তারা কথা বলতে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়, পরবর্তীতে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি ঠিক করে দেই। কাউকে কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি।’
ফয়সাল আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কারও কিছু করার সুযোগ নাই। আর কেউ যদি নাম ব্যবহার করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলগুলোতে এমন কর্মকাণ্ড যেন দ্বিতীয়বার না ঘটে এখন থেকে আমরা সচেতন থাকবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এসব বিষয়ে সচেষ্ট আছি। ছাত্র নির্যাতন ও শিক্ষক লাঞ্ছনা প্রতিরোধ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। দু-একদিনের মধ্যে এ কমিটির সদস্যরা আলোচনায় বসবেন এবং কীভাবে এর প্রতিকার করা যায় সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই আমাদের কাছে সমান। যদি কোনো শিক্ষার্থী অপরাধী প্রমাণিত হয়, তাহলে সে যেই হোক কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত অনুযায়ী সত্যতা মিললে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবো।এসজে/জিকেএস