লাঠিখেলার উদ্ভব কখন কোথায় কীভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা দুরূহ। তবে সভ্যতার সূচনাকাল থেকে মানুষ আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হাতিয়ার হিসেবে লাঠি ব্যবহার করতো এমন ধারণা করা অসঙ্গত নয়। যেহেতু আদিম যুগের মানুষ পশুপাখি শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করতো। তাই সহজেই অনুমেয় হয় যে, আদিম সমাজের মানুষ অরণ্য-পাহাড় এবং সমতল ভূমি থেকে হিংস্র বন্যপ্রাণি শিকার করার জন্য ঢাল, বর্শা এবং অন্যান্য ধারালো যন্ত্রপাতির সঙ্গে লাঠিও ব্যবহার করতো। উল্লেখ্য যে, পশু শিকারের পূর্বে ও পরে আদিম মানুষ আয়োজন করতো পশু সম্পর্কিত নৃত্য ও উৎসবের। সেসব নৃত্য ও উৎসবকালে অনেকে পশুর চামড়া, মাথা, শিং, লেজ ইত্যাদি পরিধানপূর্বক শিকার সাজে সজ্জিত হয় এবং অন্যরা শিকারিরূপে হত্যাকর্মের পুরাভিনয় করে (সূত্র: জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা)।
Advertisement
উক্ত নৃত্য উৎসব এবং অভিনয়ের সময় লাঠিখেলার কৌশলগত প্রয়োগ থাকলেও থাকতে পারে, যা মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনের ভাবনাকে ছাপিয়ে ক্রমে বিনোদনমূলক খেলা বা কসরৎমূলক নাট্য হিসেবে লোক সমাজে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য’ গ্রন্থে আশরাফ সিদ্দিকী তার ‘লোক-খেলাধুলা’ প্রবন্ধে লাঠিখেলার বিষয় ও উপস্থাপনা কৌশল আলোচনাপূর্বক একে ‘যুথবদ্ধ আদিম সমাজের খেলার অংশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনেকের মতে ‘লাঠি আদিম যুগের হাতিয়ার হলেও লাঠিখেলার উদ্ভব মধ্যযুগে সামন্ত জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়’।
ড. ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থে লাঠিখেলার উদ্ভব সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘জমিদারগণ যোদ্ধা হিসেবে লাঠিয়াল বাহিনী রাখতেন। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা মিটে যাওয়ার পর লাঠি নিয়ে শৌর্য-বীর্য ও কলাকৌশলের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় আখড়াগুলো, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বর্তমানে মহরম উপলক্ষে লাঠিখেলা অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। এদেশে মহরম উৎসব প্রচলিত হওয়ার সময় থেকে এ প্রথা চলে আসছে বলে ধরে নেওয়া যায়’।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জমিদারি আমল থেকেই লাঠিখেলার প্রচার ও প্রসার ঘটে। কারণ জমিদারদের জমিদারি টিকিয়ে রাখতে সৈন্য বাহিনীর বিকল্প হিসেবে লাঠিয়ালদের মাসিক বা বাৎসরিক বেতন, ভাড়ায় কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। প্রসঙ্গত এখানে বলা প্রয়োজন যে, ‘বরকন্দাজ আর লাঠিয়াল এক নয়। বরকন্দাজ ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের লাঠিয়াল। অন্যদিকে বেসরকারি লাঠিয়ালনগণ টাকা বা স্থাবর কিছুর বিনিময়ে জমিদার এবং অন্যান্যদের নিকট লাঠিখেলায় তার দক্ষতা বিক্রি করতো’ (সূত্র: সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাপিডিয়া, খণ্ড-৯)। এই লাঠিয়ালদের প্রধান অস্ত্র বা অবলম্বন হিসেবে থাকতো বাঁশের লাঠি। জমিদারগণ এই লাঠিয়ালদের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা, জমিদখল, খাজনা বা ট্যাক্স আদায় করার কাজে ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, যদি কোনো সুন্দরী নারীর প্রতি জমিদার কিংবা জমিদার পুত্রের কুদৃষ্টি পড়তো সেক্ষেত্রেও ঐ নারীকে জোরপূর্বক ধরে আনার কাজে ব্যবহৃত হতো লাঠিয়াল বাহিনী। এক কথায় জমিদারের ভালো মন্দ সব ধরনের হুকুম বা নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকতো তারা।
Advertisement
উদারণস্বরূপ বলা যায় যে, ‘জমিদারদের নিরাপত্তা বিধান, সরকারি কোষাগারে টাকা বহন করার সময় গোমস্তাকে পাহাড়া দিয়ে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকতো লাঠিয়াল বাহিনী (১৭০)। আবার অবসর সময়ে কিছুটা বিনোদনের জন্য লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠিখেলা প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন জমিদারগণ। উক্ত প্রদর্শনীতে জমিদার ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য, কর্মচারী এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকতেন। সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের উপস্থিতি থাকার সুযোগ এতে ছিল না। এরূপ প্রদর্শনীতে লাঠিয়াল বাহিনী সাধারণত চর দখল কিংবা সদ্য সমাপ্ত কোনো যুদ্ধ জয়ের ঘটনা উপস্থাপন করতো। লাঠিয়ালদের মধ্যে যে যত বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারতো তাকে জমিদার পুরস্কৃত করতেন। অনেকের মতে ‘ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায়ে যখন ঔপনিবেশিক রাষ্টব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত লাভ করেনি এবং সরকার যখন জমিদারদের পৃষ্ঠপোষক ছিল, তখন লাঠিয়াল বাহিনী প্রয়ঙ্করী পঙ্গপালের মতো যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো। অসহায় নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্যাতন ও নিপীড়ন করে তারা জীবনযাপন করতো।
জমিদারদের ন্যায় নীলকর সাহেবরাও অবাধ্য কৃষকদের দমন করার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী রাখতেন (১৭০)। উল্লেখ্য যে, এই লাঠিয়ালদের মাধ্যমে নীলকর সাহেবরা নীল চাষীদের উপর যে, অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতো তার ভয়ঙ্কর চিত্র প্রকাশ পেয়েছে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে। কালক্রমে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় আসে নানা পরিবর্তন। সেই সঙ্গে জমিদার প্রথাও বিলুপ্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনেরও অবসান হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হতে থাকে সৈন্য বাহিনীও। সঙ্গত কারণে লাঠিয়ালদের পেশাদারি কার্যক্রম ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে যাত্রা করে। এরা অন্য কোনো পেশাকে দক্ষতার সাথে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়না। সাংসারিক জীবনযাপনের জন্য অন্য কোনো কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। কর্মহীন জীবন তাদের মনে বিষণ্নতার ছাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরূপ প্রেক্ষিতে লাঠিয়াল বাহিনী নতুন করে নিজেরা দল গঠন করে। অতঃপর গ্রামীণ সমাজে বসবাসরত সাধারণ মানুষের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে আরও নতুন নতুন কৌশল আয়ত্বপূর্বক তার এই খেলা উপস্থাপন করতে থাকে। সুতরাং এই কথা সহজেই বলা যায় যে, মানব সভ্যতার প্রারম্ভকাল থেকে মানুষ লাঠি ব্যবহার করলেও এদেশে লাঠিখেলার উদ্ভব হয়েছে জমিদারি আমলে এবং বিনোদনমূলক খেলা বা লোকনাট্য হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছে জমিদারি প্রথা চলু হওয়ার আরও পরে।
জমিদারি প্রথার বিলুপ্ত এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এই খেলা নানারূপে ও আঙ্গিকে বিকশিত হতে থাকে এবং কাল পরম্পরায় লাঠিখেলা বাংলা লোকনাট্যের ন্যায় অজস্র বিষয় ও আঙ্গিক নির্ভর কাহিনি কাব্যের রূপরীতি আত্মীকরণপূর্বক কোথাও সর্দার বাড়ি, কোথাও হর্দার বাড়ি, পাইক খেলা ইত্যাদি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এক সময় বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাঠিখেলার আয়োজন ছিল গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের চিত্ত বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। কালের বিবর্তনে শুধু লাঠিখেলা নয়, বাংলার অসংখ্য লৌকিক খেলা বিলুপ্তির প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ খেলার প্রচলন যতটুকু আছে তা স্বউদ্যোগে। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী এই খেলা সরকারিভাবে সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাঠিয়াল বাহিনী সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় লাঠিখেলায় নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে।
তথ্যসূত্র:
Advertisement
১. জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা
২. মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা
৩. সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদক), বাংলাপিডিয়া (খণ্ড ৯)
৪. শামসুজ্জামান খান (সম্পাদক) বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য
৫. ডক্টর ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোকসংস্কৃতি
কেএসকে/জিকেএস