দেশজুড়ে

৫ টাকায় মেলে সব রোগের চিকিৎসা

চিকিৎসকের ফি, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত খরচ মাত্র পাঁচ টাকা। মুমূর্ষু রোগীদের আনা-নেওয়ার কাজে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স। সব সময় খোলা থাকে জরুরি বিভাগ। চিকিৎসার জন্য হাজার টাকা খরচ করে আর শহরে যেতে হচ্ছে না। চরবাসীর ঘরের দুয়ারে মিলছে চিকিৎসাসেবা।

Advertisement

বগুড়ার চরাঞ্চলে অবহেলিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র পাল্টে দিয়েছে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ ভাসমান হাসপাতাল। ভাসমান হাসপাতাল খ্যাত জল জাহাজটি এখন অবস্থান করছে বগুড়া সারিয়াকান্দির কর্ণিবাড়ি ইউনিয়নের দেবডাঙ্গা এলাকার যমুনা নদীর তীরে।

শুধু চরাঞ্চলের মানুষই নয়, বিভিন্ন স্থান থেকে সব শ্রেণির মানুষরা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নৌকাযোগে এ হাসপাতালে আসছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ ৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

চরবাসীদের জন্য সারাদেশে দুটি হাসপাতাল এ ধরনের সেবা চালু রেখেছে। একটি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে, অন্যটি এখন কুড়িগ্রাম জেলায় অবস্থান করছে। সারিয়াকান্দিরটি বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং জামালপুরের জেলার যমুনাচরে বসবাসরত সুবিধা বঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছে।

Advertisement

হাসপাতালে চোখ অপারেশন, লেন্স স্থাপন, দন্ত, অর্থোপেডিক অপারেশন, প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, শিশু চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা ও স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ, ঠোঁট কাটা অপারেশন, স্ত্রীরোগের চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, নাক, কান, গলার চিকিৎসা দেওয়া হয়। ডিজিটাল এক্স-রে, ইসিজিসহ সবধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন ফ্রেন্ডশিপ এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড।

নদীপাড়ের খোলা জায়গায় টিনের বেড়া আর ছাউনি দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ক্যাম্পে নারী ও পুরুষের থাকার পৃথক দুটি ঘর আছে। অস্ত্রোপচারের রোগীরা প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েকদিন সেখানে থাকেন। এখানে বিনামূল্যে অসহায়দের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজে ঢুকতেই চোখে পড়ে রেজিস্ট্রেশন পয়েন্ট ও ফার্মেসি, গাইনোকোলজি বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, ডিজিটাল এক্সরে বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ এবং বিশ্রাম কক্ষ। নিচের ডেকে থাকেন চিকিৎসক ও কর্মীরা।

কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার ধাপ গ্রামের শহীদ মিয়ার স্ত্রী আফরোজা বেগমের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই পিঠের হাড়ের ব্যথায় ভুগছিলেন। টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা নিতে পারেননি। তাই এ হাসপাতালে তিনি এসেছিলেন বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে। তিনি বলেন, ‘মাত্র পাঁচ টাকা দিয়ে ওষুধ নেকে (লিখে) নিছি, আবার সেই ওষুধ বিনা টাকাতেই পাছি। হামার খুবই এডা উপকার হলো।’

Advertisement

উপজেলার কাজলার চরের বাসিন্দা আব্দুল ছালাম বলেন, চোখে সমস্যা নিয়ে এ হাসপাতালে এসেছি। এখানে অল্প টাকায় চিকিৎসা পাচ্ছি। যা অন্য কোনো হাসপাতালে গেলে অনেক টাকা লাগতো। এ ধরনের হাসপাতাল আগে দেখিনি। হাসপাতাল খুঁজতে হয় না, হাসপাতালই রোগীদের দুয়ারে পৌঁচ্ছে যাচ্ছে।

উপজেলার শনপচা চরের আসমা বেগম বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। ম্যাল্যা দিন অসুকোত ভুগচি। ভালো ডাক্তারের কাচে যে যামো, ট্যাকা পামো কোনটে। টাউনোত যাতে অনেক ট্যাকা নাগে। দুই ব্যালা খাবার পাইন্যা, ট্যাকা জোগাড় করমো ক্যামন করি। বাড়ির কাচে জাহাজ আসি ভালো হচে। বড় ডাক্তারোক দ্যাকেয়া হামারগরে ম্যালা অসুক ভালো হচে।’

কুতুবপুর গ্রামের জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘হামরা জীবনে বড় ডাক্তারের কাচে যাবার পাইন্যাই। অসুক হলে ফকির-কবরাজের পানি পড়া খাচি। জাহাজের ডাক্তারের কাচে অপরাশোন করি হামার চোক ভালো হচে। গাঁওয়োত জাহাজকোনা না আইলে চোকের অসুক থ্যাকি গ্যালো হনি।’

সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান মতি বলেন, এসব চর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। ফলে মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে নিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। এজন্য অনেকেই অকালে মারা যান। এ বাস্তবতায় লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল মানুষের ভীষণ উপকারে এসেছে। যারা যোগাযোগ সমস্যা ও অর্থাভাবে শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেননি, তারা এখন হাতের কাছেই আধুনিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। হাসপাতালটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, চরের মানুষ আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। চরাঞ্চলে কোনো ওষুধের দোকান পর্যন্ত নেই। তাই চরবাসীর চিকিৎসাসেবার মূল লক্ষ্যেই আমাদের এই কার্যক্রম পরিচালিত। ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চরাঞ্চলের মানুষকে হাতের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়েছে।

হাসপাতালের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শাফিউল আজম জানান, চরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসাসেবা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রায় ২০ বছর ধরে যমুনাপাড়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ ভাসমান হাসপাতাল। ফ্রেন্ডশিপ একটি অরগানাইজেশন ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আমরা এক জায়গায় তিন-চার মাসের বেশি থাকি না। চর এলাকার দুস্থ, দারিদ্র ও অসহায়দের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া মূলত আমাদের কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫০-২০০ জনের অধিক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি।

তিনি আরও বলেন, নদীপাড়ের মানুষ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকেন। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের ত্যাগ এবং ইউনিলিভারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হাসপাতালটি হয়ে ওঠে দুঃসময়ের বন্ধু, মানুষের আস্থার প্রতীক।

এমআরআর/এএসএম