চার বছর আগে ঢাকার শাহবাগ শিশু পার্ক আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এখন পর্যন্ত পার্কের কাজ শুরুই করতে পারেনি তারা। কবে কাজ শুরু বা শেষ হবে তারও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই সংস্থা দুটির কাছে। অথচ পার্কটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিনোদনের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোররা।
Advertisement
শাহবাগ শিশু পার্কের (সাবেক শহীদ জিয়া শিশু পার্ক) জায়গার মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। পার্কটি পরিচালনার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। তবে এখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় পার্কটির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তাদের পার্কিং নির্মাণের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও এক বছর। এরপর আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কে রাইড স্থাপন করবে ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগ। সবমিলে এই পার্ক চালু করতে আরও দুই বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন>> বিলুপ্তপ্রায় কৃষি উপকরণের সংগ্রহশালা ‘গাঁও গেরাম ভিলেজ পার্ক’
এদিকে পার্কটি চালু আছে বা পার্কের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে মনে করে প্রতিদিন সকাল-বিকেল শিশু-কিশোরদের নিয়ে শাহবাগে যাচ্ছেন অভিভাবকেরা। বিশেষ করে শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটির দিনে পার্কে যান অনেকেই। কিন্তু পার্কটি চালু না হওয়ায় আক্ষেপ নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন তারা।
Advertisement
অভিভাবকদের অভিযোগ, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ লাভে শিশু পার্কে আনন্দ-বিনোদন একটি জরুরি বিষয়। অথচ পার্কটি সংস্কার বা আধুনিক রাইড স্থাপনের নামে চার বছর ধরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এখন বলা হচ্ছে, রাইড স্থাপনে আরও দুই বছর লাগবে। এটি তাদের উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এ অর্ধযুগে একটি প্রজন্ম শিশু পার্কে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হবে।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পার্কের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে এটি বন্ধ ঘোষণা করেছিল ডিএসসিসি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় শিশু পার্কের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শিশু পার্ক সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে।’
আরও পড়ুন>> গুলশানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্ক উদ্বোধন
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। একই সময়ের মধ্যে শিশুপার্কের নিচে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগতদের গাড়ি পার্কিং ও কিছু অবকাঠামো সংস্কারকাজ শেষে এটি খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
Advertisement
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশু পার্কটির আধুনিক রাইড স্থাপনের কাজটি করবে ডিএসসিসি। এর জন্য স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ২৬৫ কোটি থেকে ৭৮ কোটি টাকা ডিএসসিসিকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ডিএসসিসি শুরু থেকেই বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি জানায়। এমন জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত পার্কের কাজ শুরুই হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, শুরু থেকেই ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে শিশু পার্কের বিদ্যমান রাইডগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, নতুন রাইড বসাতে হবে। রাইড বসানো ও পার্কের উন্নয়নে এ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ নিয়ে দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালি হয়। আড়াই বছর আগে দক্ষিণ সিটিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু পার্ক আধুনিকায়ন করতে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরে ডিএসসিসি প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ডিএসসিসির এই প্রকল্প এখনো অনুমোদন হয়নি। কবে হবে, তারও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
আরও পড়ুন>> গুলশানের ফজলে রাব্বি পার্ক চালু হবে কবে?
সরেজমিনে দেখা যায়, আগে শিশু পার্কটি যে জায়গায় ছিল, তার বেশির ভাগ অংশেই ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিংয়ের ছাদ মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু। এর মধ্যে কোন মডেলে পার্কিং হবে বা শিশু পার্কের নকশা কেমন হবে তার কোনো তথ্য বা থ্রিডি ছবি টাঙানো নেই। শুধু ফটকে ছোট্ট একটা টিনে লেখা ‘সাবধান পার্কের উন্নয়নের কাজ চলিতেছে।’
সাংবাদিক পরিচয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শিশু পার্কের ভেতরে যে রাইডগুলো ছিল এখন তার অধিকাংশ রাইডের অস্তিত্ব নেই। চরকিজাতীয় আলাদা দুটি রাইড আট ফুট উঁচু টিন দিয়ে ঘেরা। পার্কের পশ্চিম পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে বিমানবাহিনীর উপহার দেওয়া সেই জেট প্লেন। প্লেনের ওপর ধুলাবালিসহ লতাপাতা ছড়িয়ে রয়েছে। কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শাহবাগ এলাকায় ঘুরতে যান কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন। বিকেল নাগাদ শাহবাগ শিশু পার্কের সামনে আসেন তারা। কিন্তু পার্কের ফটকে তালা দেখে ফিরে যান। একই সময় আরও কয়েকজন অভিভাবককে শিশুদের নিয়ে ফিরে যেতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন>> জৌলুস হারাচ্ছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
হাফিজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, তিন বছর আগে দেখেছি এই শিশু পার্কের নিচে পার্কিং তৈরির কাজ চলছে। এখনো দেখি আগের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রধান ফটকে তালা লাগানো। অথচ শিশু-কিশোরদের বেড়ানোর জন্য ঢাকায় কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, এই শিশু পার্কে মাত্র ১০ টাকা হারে ছয়টি রাইড ব্যবহার করতে পারতো শিশুরা। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো শিশু-কিশোর আসতো। চার বছর ধরে পার্কটি বন্ধ থাকায় এখন শিশু-কিশোরদের সেই কোলাহল নেই।
ডিএসসিসি প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, দুই বছর আগে ওই প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন কমিটির পরবর্তী সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া ও পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নকাজ শুরু হবে। এই কাজে ডিএসসিসির আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
তবে ঠিক কবে পার্কের আধুনিকায়ন শুরু হবে, আর শেষ হবে কবে তা সুনির্দিষ্ট করে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে শাহবাগে ১৫ একর জায়গার ওপর শহীদ জিয়া শিশু পার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে শিশুদের বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন থেকে পার্কটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পার্কটিতে একটি খেলনা ট্রেন, একটি গোলাকার মেরি গো রাউন্ড রাইড ও একাধিক হুইলসহ ১২টি রাইড ছিল। ১৯৯২ সালে এ পার্কে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে সৌজন্য হিসেবে একটি জেট প্লেন দেওয়া হয়েছিল।
শহীদ জিয়া শিশু পার্ক এখন ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্ক’
২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দ্বিতীয় পরিষদের ১১তম বোর্ডসভায় শহীদ জিয়া শিশু পার্কের নাম ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্ক’ করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার সড়ক, ভবন ও স্থাপনা নামকরণ সংক্রান্ত উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সুপারিশের আলোকে নতুন নাম প্রস্তাব করা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন পায়।
এমএমএ/এএসএ/এমএস