দেশজুড়ে

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে মায়ের আঁচলে আগলে রেখেছে সুন্দরবন

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে আগলে রেখেছে মায়ের আঁচলের মতো করে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, লবণ পানির কুমির, হরিণ, অসংখ্য প্রজাতির পাখি, শুকরসহ নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে এই বনে। তবে শিকারিদের অত্যাচার, বনদস্যুদের উপদ্রব, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আজ সুন্দরবনের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।

Advertisement

বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ৫১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬৬ শতাংশ) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৪ শতাংশ) রয়েছে ভারতের মধ্যে।

২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশ-এর উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ শতাংশ বনই সুন্দরবন। এ বনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছ। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ।

Advertisement

তবে এই বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের বাঘের প্রকৃত সংখ্যা কত তা জানার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একাধিকবার গণনা করা হয়েছে। বাঘ গণনার জন্য নেওয়া হয়েছে আধুনিক পদ্ধতিও। বর্তমানেও ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে চলছে এই ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণীটি গণনার কার্যক্রম।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৫টি। ১৯৮৪ সালে সুন্দরবনের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি। ২০১৮ সালে জরিপের ফলাফলে সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি।

২০০৪ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৪৪০টি বাঘের মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় ৮৯টি পুরুষ, ১৭০টি স্ত্রী এবং ১২টি বাঘ শাবক, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ, ১২৮টি স্ত্রী এবং ৯টি বাঘ শাবকের অবস্থান জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ দেড় যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছে সুন্দরবনে। আর কয়েক বছরে বেড়েছে মাত্র আটটি বাঘ।

তবে বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছে বন বিভাগসহ বনের ওপর নির্ভরশীল জেলে ও বাওয়ালিরা।

Advertisement

সম্প্রতি সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘ শাবকের দেখা মিলছে বলে জানান সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা। বাঘের চামড়া খুব দামি হওয়ায় চোরা শিকারিদের কবলে পড়ে এই প্রাণীটি এক সময় হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু বন বিভাগের টাইগার রক্ষা প্রকল্পের কারণে বর্তমানে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাঘের চেয়েও সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি মারা পড়ছে মায়াবী হরিণ। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার চোরা শিকারিরা বনে ফাঁদ পেতে ও গুলি করে হরিণ নিধন করছেন। হরিণে মাংসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় কোনো বাধাই মানছেন না চোরা শিকারিরা। প্রায় প্রতিদিনই বন বিভাগ ও অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো হরিণের মাংস উদ্ধার করছে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে।

সুন্দরবনকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে ফেলেছে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। এর ফলে গত কয়েক বছর সুন্দরবনের খাল ও নদীগুলো মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে সুন্দরবন থেকে মাছ ধরা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু মাছ নয়, বিষের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। তবে সুন্দরবনজুড়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশ অব্যাহতভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

খুলনার সুন্দরবন একাডেমির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ুর পরিবর্তন ও লবণাক্ততা বাড়াসহ আরও কিছু কারণে দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে কমছে সুন্দরী গাছের সংখ্যা। অন্যদিকে, বেশি লবণসহিষ্ণু গাছ বাড়ছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনের পুরাতন জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, বন্যপ্রাণী রক্ষায় সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ বনভূমিকে অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যে শর্ত, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাঘের প্রজনন বাড়বে। প্রজনন বাড়লে বাঘও বাড়বে।

র্যাব-৬ খুলনার অধিনায়ক (সিইও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমদ বলেন, সুন্দরবনকে জলদস্যু ও বনদস্যুমুক্ত করতে র্যাবের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করা হচ্ছে। র্যাবের কারণে সুন্দরবন আজ দস্যুমুক্ত। শুধু বনদস্যুই নয় চোরা শিকারিদের উৎপাতও কমেছে। বন্যপ্রাণী রক্ষা ও অপরাধ দমনে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।

বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুই কোটি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থাও সুন্দরবনের ওপর কমবেশি নির্ভরশীল। তাই যেকোনো মূল্যে আমাদের প্রাকৃতিক এই সুরক্ষা দেওয়ালকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আলমগীর হান্নান/এমআরআর/এমএস