একখানা দুঃসংবাদ দিয়ে বরং শুরু করা যাক, তাতে দুঃখের পরে সুখের আলাপ বেশি ভালো জমবে। আমাদের পাড়ার হাকিম আঙ্কেল সেই কবে ভালো বেসেছিলেন, তারপর নয় নয় করে চল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে গেলো, এখন নাকি তিনি সেই প্রেমের দুরন্ত দুর্বার ফল ভোগ করছেন! কেসটা কী তাহলে শুনুন।
Advertisement
আজ পহেলা বসন্তের প্রথম প্রহরে হাকিম আঙ্কেল গেছেন হারু নাপিতের দোকানে চুল ছাঁটতে। হারুর আসল নাম যে কী, তা অবশ্য কেউ জানে না। হতে পারে হারু, হরেন কিংবা হারুন, নাম যাই হোক তাকে কিছু আটকায় না। সে খুব ভালো চুল ছাঁটতে পারে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। নাপিতের আবার নাম! তার নাম কেন লাগবে! কথা কবে তার ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচাত, মানে কাঁচি ও শাণিত ক্ষুর।
যাকগে যাক, আমাদের সেই হাকিম আঙ্কেল হারুর দোকানে গিয়ে সখেদে বললো, ভাই রে, এমনভাবে চুলটা কমিয়ে দিস (কামিয়ে নয় কিন্তু) যেন তোর আন্টি রাগের মুখে হাতে বাড়িয়ে চুলের নাগাল না পায়। অর্থাৎ চুলে ধরে আদর করার ছলে আমার কানের গোড়ায় দু’ঘা বসাতে না পারে।
হারু নাপিত ভীষম অবাক। সে কি কাগা, আন্টি আপনের কানের গোড়ায় মারে! এই বয়সে! ক্যাঁ? কসুর কী আপনার?
Advertisement
তাতে কাষ্ঠ হাসেন হাকিম। কসুর যে আসলে কী, তা ছাই তিনি নিজেও কি জানেন! মেয়েলোকের মেজাজ এই ভালো এই খারাপ। লন্ডনী বৃষ্টির মতো। বউয়ের হাতে লাথিগুঁতো খেতে আবার কসুর লাগে নাকি! তাছাড়া ওটা তো আর মাইর-চটকানা না, ভালোবাসার আদর, বুঝলি হারু। বিয়াত্তা পুরুষ মাত্রই বিলক্ষণ তা জানে।
হারু কাজের মানুষ। সে আর বিশেষ কথা বাড়ায় না। মুচকি হেসে কাজে লেগে পড়ে, এবং হাকিম আঙ্কেলের চুলে একরকম বাটিছাঁট দিয়ে দেয়, যাতে আন্টি তার ওপর যতই রাগুক, তার চুলের মুঠি আর কিছুতেই ধরার পারবে না। আধা ইঞ্চি চুল, আর আবার ধরবে কী!
অথচ এই নাজু আন্টির জন্য একদিন কী না করেছেন হাকিম! ভালোবেসে বলতে গেলে দিল-দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। ন’দিন ন’রাত স্রেফ ডাবের পানি খেয়ে অনশন করেছেন। একসময় মনে হতো, নাজমা ছাড়া তার জীবনে আর কেউ নেই, কিছু নেই।
ওর সেই অল্প ট্যারা (এখন যা দেখে ঈগলের চোখ বলে ভ্রম হয়) চোখে তিনি দুনিয়া দেখতেন, তখন তার জীবনের একটাই মানে ছিল- নাজুর সঙ্গে উড়াধুড়া ঘুরে বেড়ানো, এক গ্লাসে দুজন মিলে চা পান আর নাজুর কথা মনে পড়লেই তার হলের গেটে গিয়ে বর্ষীয়ান কচ্ছপের মতো হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা।
Advertisement
আর সেই নাজু এখন পান থেকে চুন খসলেই চুলের মুষ্ঠি ধরে পোকায় ধরা দাঁত কিড়মিড় করে কানের গোড়ায়...! নাহ, আর ভাবতে চান না হাকিম আঙ্কেল। মনে মনে শুধু একটাই কথা আওড়ান, সখি, ‘ভালোবাঁশা’ কারে কয়! সে কি কেবলই গুঁতানিময়!
বস্তুত, কেউ ভালোবেসেছে আর কখনও গুঁতো খায়নি এমন কথা শোনাও পাপ। এ কখনও হতেই পারে না। এ যেন সোনার পাথর-বাটির মতোই অবিশ্বাস্য। রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। অথচ ভালোবাসা ছিল সেই আমাদের কালে। একে অন্যের জন্য জীবন অব্দি দিয়ে দিতে পারতো।
নিজে না খেয়ে প্রেমাস্পদকে খাওয়াতো, বাপের ন্যায় অপত্য স্নেহে বেড়াতে নিয়ে যেতো, নিজ দায়িত্বে নোটফোট, বই-পত্তর কতো কী জোগাড় করে দিত, নিজের টিউশনি তুলে দিত প্রেমিক কিংবা প্রেয়সীর হাতে।
রাস্তা পার হওয়ার সময় বিল্লিছানার মতো পরম যত্নে পারলে কোলে তুলে নিয়ে পার করে দিত। নিজের প্রেমিকার দিকে অন্য কেউ চোখ মেলে তাকালে কালু ডাকাতের মতো তার চোখ তুলে নেওয়ার হুমকিও দিত (অথচ সে নিজে তালপাতার সেপাই, যেন এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে)। সে কি পসেসিভনেস! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়! যেন লাভারকে তারা ভালোই বাসেনি শুধু, জন্মও দিয়েছে। তাই তাকে নিয়ে ছলছুতো, কিল-গুঁতো যা খুশি তাই করা যেত।
আর এখন! লোকের এত টাইম কই যে প্রেম করবে! আগে মানুষ প্রেমপত্র লিখতো, আর এখন লেখে চাকরির জন্য রেজিউমি। ‘লাভার লেটারের’ বদলে রাত জেগে লিখছে শুধু কাভার লেটার। পাবলিক বুঝে গেছে, শুধু মন ভাঙিয়ে খাবার দিন শেষ, তাতে না হয় প্রেম, না ভরে পেট।
মনের চেয়ে বরং হরমোনের গুরুত্ব এখন বেশি। যার শরীরে টাকাকড়ি বাড়ি গাড়িজনিত এড্রেনালিনের নাচন যত বেশি, তার তত বড় ফিউচার। প্রেম এখন আর নীল খামে নয়, বদলে গিয়েছে ঘামে। পেটের খাবার জোগাতেই ওরা হিমশিম খায়, প্রেম করবে কখন?
অথচ একটা সময় ছিল, যুতসই একজন মনের মানুষ জোটাতে কী না করেছি আমরা! চণ্ডিদাস-রজকিনী, শিরি-ফরহাদ, শাজাহান-মমতাজের মতো হৃদয় বাজি রেখে লড়ে গেছি বীর পুঙ্গবেরা সব। প্রেম যেন বেঁচে থাকার টনিক। প্রেমাস্পদকে ক্ষণিক না দেখলেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, দুনিয়ার সবকিছু যেন অর্থহীন মনে হত। আর জীবনে প্রেম এলে কিচ্ছু চাই না আর।
আবার কারো কারো অবস্থা ছিল, ‘চুন খেয়ে পোড়ে মুখ, দই দেখে কাঁপে বুক’ গোছের। নিন্দুকের মতো তারা বলত, প্রেম মানেই গুচ্ছের সময় নষ্ট, অকারণ মনে কষ্ট। অর্থাৎ হতে হতেও হয়নি বা খুবজোর ছ্যাঁকা খেয়েছে তারা, তাই আল্জিভ পুড়িয়ে সব দোষ তখন বেচারা ভাজামাছের!
মেলা কথা হল। প্রেমের সেকাল- একাল, মহাকাল নিয়ে। কালে কালে কতো কী বদলে যায়। যাচ্ছে আরও। তারপরও বলি, প্রেমে স্বার্থগন্ধ এলে আর তার মাধুর্য থাকে না। পুরো ব্যাপারটাই তখন লেনদেন আর বেসাতি হয়ে যায়। গিভ অ্যান্ড টেক, এসবই তো চলছে এখন! আজকালকার তরুণ-তরুণীদের বড্ড তাড়াহুড়ো। সকালে মিসড্ কল মেরে বিকেলেই ডেট, তার টুকটাক কিছুদিন চিটচ্যাট, লিটনের ফ্ল্যাট এইসব।
শুরুতেই ভাঙনের সুর, কতশত ভাঙচুর! মনের সেই জোর যেন আর নেই। না থাকে জোর, না লাগে জোড়া। কেন ভাই, একটু রয়েসয়ে কিছু করা যায় না! সময় দাও। সময় না দিলে কিছুই টেকে না- না সম্পর্ক, না জীবন। আর চাই ত্যাগের মানসিকতা। সবকিছুতে কমপিটিশন মানায় না। বোঝাবুঝির দরকার। মন থেকে, হৃদয় থেকে।
সকলকে পয়লা বসন্তের শুভেচ্ছা। সবার জীবনে ভরপুর প্রেম আসুক, সুনামির মতো। টিকে থাক অযুত বছর।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/জিকেএস