দেশজুড়ে

বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রাক উঠলেই বেড়ে যায় ওজন!

মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতুতে মাপা ট্রাকসহ মালামালের ওজন বঙ্গবন্ধু সেতুর ওয়েট স্কেলে এসে বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে ট্রাকচালকদের।

Advertisement

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের ওয়েট স্কেলে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার ট্রাকের ওজন পরিমাপ করা হয়। বাড়তি ওজন বহনকারী প্রতিটি ট্রাকের পুনরায় স্কেল বাবদ স্লিপে নেওয়া হয় ৫০ টাকা। আর বাড়তি পণ্য অন্য ট্রাকে সেতু পার করে নিতে গুনতে হয় সাত হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন ট্রাকচালকরা।

এদিকে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ওজন না আসা ট্রাকের কোনো ফি নেওয়া হয় না। তবে ট্রাকগুলো প্রায় দুই কিলোমিটার ঘুরে এসে ফের ওজন করাতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন চালকরা।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাকচালক হযরত আলী বলেন, মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতুর ওয়েট স্কেলের থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওয়েট স্কেলের মাপে সবসময় এক থেকে দেড় টন ওজন বেশি দেখায়। এ কারণে ২২ টন মাল নিয়েও সঠিক পরিমাপের জন্য আমাদের দু-তিনবার অতিরিক্ত ঘুরতে হচ্ছে। স্লিপের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ প্রতিবার ৫০ টাকা নিলেও আমাদের ঘুরতে গিয়ে তেল খরচ হচ্ছে প্রায় হাজার টাকার। এছাড়া ২২ টনের অধিক হলে বাড়তি মাল সাত হাজার টাকায় অন্য গাড়িতে সেতুর পশ্চিম পাড়ে নিতে হচ্ছে।

Advertisement

ট্রাকচালক মো. রেজাউল করিম অভিযোগ করে বলেন, চালক, হেলপার ও ট্রাকের ওজনসহ মোট ২১ টন ৯৮০ কেজি ওজন নিয়ে আমি চট্টগ্রাম থেকে রওয়ানা দিই। যাবো রংপুর। ছয় চাকার গাড়িতে ২২ টন ওজন পরিবহনের অনুমতি রয়েছে আমাদের। সেখানে ২০ কেজি ওজন কম নিয়েই আমি যাত্রা শুরু করি। তবে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওয়েট স্কেলে এসে আমার ট্রাকসহ মালামালের ওজন বেড়েছে আরও ৩০০ কেজি। এ কারণে আমাকে স্লিপের ৫০ টাকা জরিমানা দিয়ে সঠিক পরিমাপ পেতে চারবার ঘুরতে হয়েছে।

তিনি বলেন, নির্ধারিত ওজন অনুযায়ী মাল নিয়েও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরতে হয়। এ কারণে লোড-আনলোড পয়েন্টের যানজটে আটকে থেকে সময় নষ্ট হচ্ছে।

রেজাউল করিম বলেন, পরিমাপ সঠিক পেতে চারবারে হাজার টাকার তেল আর স্লিপের ৫০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ট্রাকের পেছনের কিছু মাল সামনে এনেই ওজন ঠিক পাওয়া গেছে।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, সেতুর পূর্বপাড়ে ওজন নিয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। সেতুর পশ্চিমপাড়ে হয়রানি কিছুটা কম। পূর্বপাড়ের ওয়েট স্কেলে কী ঝামেলা, সেটিও জানার কোনো সুযোগ নেই।

Advertisement

ঢাকা থেকে বগুড়াগামী ট্রাকচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ১২-১৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে চলাচল করে আসছি। প্রতিনিয়ত ঢাকা-বগুড়া যাতায়াত করি। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে আমরা ট্রাকসহ ২২ টন মালামাল বহন করতে পারবো। কিন্তু অনেক সময়ই এর চেয়ে কম ওজন বা খালি ট্রাকও ওয়েট স্কেলে না মেপে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে ওয়েট স্কেলের দায়িত্বরতরা বলেন, আপনি ঘুরে আসেন, ওজন আসেনি। এতে আমাদের দেড় বা দুই কিলোমিটার দূরের লোড-আনলোড পয়েন্টে যেতে হয়। ওই পথ ঘুরতে যে পরিমাণ তেল খরচ হয়, সেই টাকাটা আমাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কম ওজনের গাড়িকে দুই কিলোমিটার পথ ঘুরিয়ে এভাবে হয়রানি করা হলেও ওভার লোডের বেশকিছু ট্রাককে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বাধাহীন পারাপার হতে। ওই ট্রাক কোম্পানির সঙ্গে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ আছে বলে আমার ধারণা।

লালমনিরহাটগামী ট্রাকচালক মো. সুজন বলেন, গতি বেশি অথবা তাদের দাবি অনুযায়ী স্কেলে না যাওয়ার কারণে গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে খালি গাড়ি নিয়েও আমাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ৫০ টাকার স্লিপ নেওয়া ব্যতীত সেতু কর্তৃপক্ষের কী লাভ হচ্ছে সেটি আমি জানি না। এতে আমাদের তেল খরচ বাড়ছে। তবে এ কারণে আমরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড়ের ট্রাক লোড-আনলোডের শ্রমিক সর্দার জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার বলেন, সেতু পারাপারে পণ্যবাহী ট্রাকের অতিরিক্ত মালামাল লোড-আনলোডের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে একটি পয়েন্ট আছে। সেটি ইজারা বা ভাড়া দেওয়া হয়নি। তবে আমি প্রায় ১২/১৩ বছর ধরে সেতুর ওই পয়েন্টে লোড-আনলোড কাজের শ্রমিক সর্দার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম অংশে লোড-আনলোডের কাজে আমাদের প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছে।

তিনি বলেন, সেতুর নির্ধারিত ওজনের থেকে ট্রাকে আনা বাড়তি মালামাল আমরা লোড-আনলোড করি। পূর্বপাড়ের পয়েন্টে সেতু পারাপারের জন্য থাকা খালি ট্রাকে বাড়তি মালামাল তুলে দিই। এই লোড-আনলোডের জন্য আমরা শুধু মজুরি পাই। তবে ওয়েট স্কেলে কী হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।

এদিকে, চালকদের অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে ওয়েট স্কেলের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিপো ম্যানেজাররা ওজনের সঠিক তথ্য না দেওয়ায় সেতুর ওয়েট স্কেলে বাড়তি ওজনের ঝামেলায় পড়ছেন চালকরা। এছাড়া সেতুর নির্ধারিত স্পিড তিন থেকে আট কিলোমিটার গতির অধিক গতিতে পারাপারের প্রবণতাসহ চালকরা ওজন ফাঁকি দিতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। এরইমধ্যে বেশ কয়েকজন ডিপো ম্যানেজারকে চালকদের ওজনের সঠিক তথ্য না দেওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসানুল কবির পাভেল বলেন, আমরা নানা ধরনের অভিযোগ পাচ্ছি। এরপরও সেতুতে নিযুক্ত কেউ যদি চালক বা কারও কাছ থেকে সুবিধা দিতে টাকা নিয়েছেন এমন তথ্য আমাদের অভিযোগকেন্দ্র অথবা কর্তৃপক্ষকে জানান তাহলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ কর্মকর্তা বলেন, দাউদকান্দি বা অন্য সেতুর ওয়েট স্কেল আমাদের মানের সমতুল্য নয়। মনে হয় ওই সেতুগুলোর স্কেল স্ট্যান্ডিং। তবে আমাদের সেতুতে ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক ওয়ে ইন মোশন স্কেল। যা চলাচলরত অবস্থায় পরিমাপযোগ্য। এই স্কেলে দাঁড়ানো ট্রাকের মাপের ওজন থেকে কিছু ওজন বাড়তে পারে এটা বিশ্ব স্বীকৃত। এছাড়া বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিগুলোতে ব্যবহৃত ওয়েট স্কেলগুলোতে ট্রাকগুলোকে থামিয়ে মাপা হয়। এ কারণে আমাদের সেতুর অত্যাধুনিক ওয়ে ইন মোশন স্কেলে সেই মাপে কিছু ভিন্নতা পাচ্ছেন চালকরা।

তিনি আরও বলেন, অনিয়ম, দুর্ঘটনাসহ সার্বক্ষণিক ১৩২টি ক্যামেরায় সেতু তদারকি হচ্ছে। সেতুর স্কেল তদারকির জন্যও প্রকৌশলী নিযুক্ত আছেন। তেমন কোনো পার্থক্য দেখলে অবশ্যই তারা বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

এমআরআর/এএসএম