‘পরপর দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না’, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’- প্রভৃতি বিষয় সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করছে বিএনপি। তৈরি করা হয়েছে ২৭ দফা। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর রূপরেখা সংযোজিত হয়েছে এতে। এখন চলছে ঘষামাজার কাজ। ২৭ দফার আলোকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার চূড়ান্ত করবে দলটি।
Advertisement
সূত জানায়, ২৭ দফা নিয়ে ঘষামাজার কাজ চলছে। বিষয়টি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে সব মহলের মতামত। কাঙ্ক্ষিত সব মহলের মতামত পেলে ২৭ দফা নিয়ে ফের বসবেন বিএনপির দায়িত্বশীলরা। আলাপ-আলোচনার পর এই রূপরেখা সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমেই প্রণয়ন হবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ইশতেহার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পরপর দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ বিষয়গুলি দেশ-বিদেশের সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
আরও পড়ুন>> ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে ‘কৌশলী’ বিএনপি
বিএনপির ২৭ দফা
Advertisement
১. একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বর্তমান ‘অবৈধ’ আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে তা রহিত বা সংশোধন করা।
২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা।
৩. একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
৪. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা।
Advertisement
৫. পরপর দুবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
৬. বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন।
৭. সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
আরও পড়ুন>> চলমান কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির তৃণমূলে সংশয়
৮. বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ সংশোধন করা।
৯. সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভোটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া।
১০. নিশ্চিত করা হবে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা। বর্তমান বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গঠন করা হবে একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’।
১১. একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা।
১২. মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা।
১৩. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী নিয়োগ করা হবে ন্যায়পাল।
১৪. সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করা হবে আইনের শাসন। মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস চার্টার অনুযায়ী।
১৫. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠন করা হবে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন।
১৬. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’—এ মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বি নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন।
১৭. মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে।
১৮. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করা।
আরও পড়ুন>> জোট রাজনীতিতে বিএনপি লাভবান না ক্ষতিগ্রস্ত?
১৯. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের ভিন্নমতবিরোধী শক্তি ও রাজনৈতিক বিরোধীদল দমনের অপতৎরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা ও আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে।
২০. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা।
২১. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে, যেন তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
২২. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
২৩. যুবসমাজের ভিশন ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে প্রণয়ন করা হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা।
২৪. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্ব দেওয়া এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২৫. প্রাধান্য দেওয়া হবে চাহিদাভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে।
২৬. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’—এ নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’র আদলে চালু করা হবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা।
২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বিমা, পশু বিমা, মৎস্য বিমা ও পোলট্রি বিমা চালু করা হবে। নিরুৎসাহিত করা হবে কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহার।
সার্বিক বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করা। এর জন্য আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। দাবি আদায় হলে আমরা অবশ্যই নির্বাচনে যাবো।
আরও পড়ুন>> বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল, যা ভাবছেন মিত্ররা
নির্বাচনী ইশতেহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে ২৭ দফা জাতির কাছে উপস্থাপন করেছি। পরবর্তীসময়ে সবার পরামর্শে এই দফাগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে।
দলের অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদের সব বিষয়েই প্রস্তুতি আছে। এরই মধ্যে ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার আলোকেই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি হবে। তবে কিছু ইম্প্রুভ করা হবে। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আমাদের সঙ্গে আন্দোলনরত শরিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে।
কেএইচ/এএসএ/জেআইএম