হারেজ উদ্দিন আসল নাম হলেও পলান সরকার নামেই তিনি পরিচিতি পান। কেউ আবার বইদাদুও ডাকতেন তাকে। নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য তিনি ২০১১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
Advertisement
২০০৭ সালে সরকারিভাবে তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ১ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান পলান সরকার। এরপরই থেমে গেছে তার বই বিলি। নতুন করে আর কেউ বাড়ি বাড়ি বই নিয়ে যান না। এমনকি কোথাও লিখে না রাখার কারণে তার মৃত্যুর পর হারিয়ে গেছে অনেক বই। পাঠাগারেও কমেছে পাঠকের তুলনামূলক আনাগোনা।
বইদাদু না থাকায় কমেছে বইপ্রেমও। অনেকে কর্মব্যস্ততার কারণে বইও নেন না। বই পড়ার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
রাজশাহী বাঘা উপজেলার বাউসা এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেন বলেন, আগে দাদু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতেন। বই হাতে পেতে সুবিধা হতো। এখন তিনিও নাই, তাই বই দিয়ে আসার মতোও কেউ নাই। আবার ঠিক সময়ে পাঠাগারে বইটা যে নিতে আসবো সেটিও হয় না। কারণ পাঠাগার অনেক সময় বন্ধ থাকে। এজন্য বই পাড়ার সুযোগটা নষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে কেউ বই পৌঁছে দিলে বা কেউ থাকলে আবার পাড়ার সুযোগ পেতাম।
Advertisement
বাউসা বাজারে চা দোকানি হানুফা বেগম বলেন, আমরা দাদার বই শুরু থেকেই পড়ে আসছি। একসঙ্গে ১০-১৫ জন গিয়ে বই আনতে যাই। অনেকে আবার কাজের চাপে বই পড়ার সময় পান না। দাদু তো নাই। তিনি তো মারা গেছেন। তাই তাদেরও বই পড়া শেষে হয়ে গেছে।
হানুফা আরও বলেন, বইপড়া একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদু এ কাজটি করে দিয়েছেন। তবে এখন বই পেতে বেশ কষ্ট করতে হয়। কখন লাইব্রেরি খুলবে আবার কখন আসবো তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতে হয়। তাই অনেকেই এসব ঝামেলার কারণে বই পাড়াই বাদ দিয়েছেন বলে শুনেছি।
পলান সরকার পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ও পলান সরকারের ছেলে হায়দার আলী বলেন, আব্বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিলিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন আমাদের দ্বারা সেই কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়েছে তার বেশি পাঠকই ছিলেন নারী। তিনি চিন্তা করেছেন, মেয়েরা অনেক পিছিয়ে আছে। তাদরে শিক্ষার প্রয়োজন। তাদের শিক্ষার জন্য তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন ও বই বিতরণ করেছেন। আমরা সবাই কর্মব্যস্ত মানুষ। তার মতো কাজ আমাদের কখনই করা সম্ভব না। আমরা চেষ্টা করছি আব্বার রেখে যাওয়া পাঠাগারটি চালু রাখতে।
হায়দার আলী আরও বলেন, আমরা বিকল্প পন্থা চালু করেছি। এখন আড়ানী, আড়ানী স্টেশন, বাউসা বাজার, দিঘা বাজার, তেলুলিয়া আমুপুর বাজার, খাবড়ি বাড়ি বাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন দোকানদারের কাছে আমরা বই রেখেছি। সেই এলাকার পাঠকরা সেখানে গিয়ে বই পড়তে পারবে। কিছুদিন পর কিছু বই বদলে দেই।
Advertisement
তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঢাকায় বাস করছে। ফলে এ পাঠাগার পরিচালনা করা খুবই দুরূহ হয়ে যাবে। আর পাঠাগার চালাতে যে খরচ সেটা প্রধান একটা সমস্যা। আব্বার একুশে পদকের সম্মানী বাবদ ১ লাখ টাকা ব্যাংকে রেখে সেখান থেকে মুনাফা দিয়ে পত্রিকা এবং অন্য খরচ নিজে থেকে কিছু দিয়ে পরিচালনা করছি। এখানে একটি গ্রন্থাগারিক খুবই জরুরি। এছাড়া পাঠাগার চালানো সমস্যা হবে। আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি আমরা রাখতে পারছি না।
‘পাঠাগারে নিয়মিত পাঠক আসে। তবে খুবই কম। অনেক পাঠকই আছে শুধু পত্রিকা পড়তে আসেন। আনেকে মোবাইলে তথ্য পেয়ে যাওয়ায় আর আসে না।’ যোগ করেন হায়দার আলী
পলান সরাকরে পাঠাগাররে দাপ্তরিক সম্পাদক ও পলান সরকারের নাতি শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রথম থেকেই এ পর্যন্ত আমি দাপ্তরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। নানা অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনেক কিছু ভুলে যেতেন। যেটা আমরা অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। সে সময়ে আমাদের এ পাঠাগারে বেশ কিছু বইয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি। বইগুলো আর কেউ ফেরতও দেয়নি। পাঠাগারের প্রায় ২ হাজারের বেশি বই নেই।
এসজে/জেআইএম