মতামত

নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশা

এমন রাজনৈতিক চমক বাংলাদেশের মানুষ অনেকদিন পায়নি। কোনো না কোনোভাবে খবর ফাঁস হয়ে যেতো। এবারও সাংবাদিকরা নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে অনেকের নাম অনুমান করেছেন। দিনের পর দিন সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাদের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, টেলিভিশনে।

Advertisement

অনুমানটা নির্দিষ্ট ছিল না বলে সম্ভাব্য নামের সংখ্যা ছিল বেশি। বিভিন্ন পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইনে অন্তত ১০ জনের নাম দেখেছি। অনেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষার খবরও পড়েছি। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন, এ কথা বলে সংসদ সদস্যরা সংসদেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনার মনে ছিল ভিন্ন কথা।

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সংসদীয় দলের সভায় সর্বসম্মতভাবে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় মনোনয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি সেটি মনের গহীনে লুকিয়ে রেখেছিলেন মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন পর্যন্ত। চমকটা হলো মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম কারও রাডারেই ধরা পড়েনি।

ঘুণাক্ষরেও যার নাম কেউ ভাবেনি, তিনিই হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি। যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন, তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন, এটা নিশ্চিত। কারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার সংসদ সদস্যরা। রোববার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপপুর নামেই দুটি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। আর কেউ যেহেতু মনোনয়ন জমা দেননি, তাই তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

Advertisement

আজ সোমবার মনোনয়নপত্র বাছাই হবে, কাল মঙ্গলবার প্রত্যাহারের দিন। একাধিক প্রার্থী থাকলে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি সংসদ কক্ষে ভোটাভুটি হতো। তা যেহেতু লাগছে না ধার্য করা হয়। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি। তবে যেহেতু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রার্থী একজন, তাই ভোটগ্রহণের প্রয়োজন হচ্ছে না।

তার মানে আগামীকাল মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচিত হলেও শপথ নেওয়ার জন্য তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। পরপর দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৪ এপ্রিল। তারপরই মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে শপথ নিতে হবে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পরই চারদিকে চাঞ্চল্য কে এই চুপ্পু, কেন তাকে এত বড় পুরস্কার দেওয়া হলো। এটা ঠিক জনপরিসরে তিনি খুব পরিচিত নন। তবে ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থেকেছেন। তবে এটা ছাড়াও আরও অনেকগুলো কারণ আছে। মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জীবনের তিনটি অধ্যায়।

১৯৪৯ সালে পাবনায় জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পাবনায়ই ছিলেন। জেলা পর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বাকশাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সক্রিয়ভাবে। পাবনায়ই সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে যোগ দেন। ২৫ বছর চাকরি শেষে ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসরে যান। চাকরিজীবন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

Advertisement

চাকরি জীবন শেষে জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর তাণ্ডব চালায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই তাণ্ডব তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।

সে তদন্ত শেষে তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি অন্যতম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। পরে তাঁকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা হয়। সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি ঘোষিত বিভিন্ন উপ-কমিটির তালিকায় তিনি প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান।

এবার আসা যাক, শেখ হাসিনা কেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বেছে নিলেন। জীবনের প্রথম পর্বে তিনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের, বাকশালের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তবে প্রথম পর্বে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ’৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। পাবনায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তিন বছর কারাগারে ছিলেন।

২৫ বছরের চাকরি জীবনেও তিনি আওয়ামী আদর্শে অবিচল ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি জীবন শেষে তিনি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তাণ্ডবের তদন্তের কথা তো বলা হয়েছেই। তবে দল, দেশ ও জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেন দুদকের কমিশনার থাকার সময়।

দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের পথ ধরে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও নিজেদের সরিয়ে নিলে বাংলাদেশ বিপাকে পড়ে। পদ্মা সেতু নির্মাণের চেয়ে তখন বড় হয়ে উঠেছিল দেশের ভাবমূর্তি। শেখ হাসিনার সাহসিকতায় নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে।

তবে শেখ হাসিনা সেই সাহসটা পেয়েছিলেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর কাছ থেকে। দুদক কমিশনার হিসেবে তিনি তদন্ত করে প্রমাণ করেছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থক কমিশনার তদন্ত করে বললেই সবাই সেটা মানবেন কেন। মানতে হয়েছে, কারণ দুদকের তদন্ত গ্রহণ করেছিল কানাডার আদালত।

এভাবে আড়ালে থেকে তিনি দেশকে একটি বড় কলঙ্কের দায় থেকে বাঁচিয়েছিলেন। মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বরাবরই আড়ালে থেকে দলের জন্য কাজ করেছেন। জীবনের তিন পর্যায়ের ত্যাগের মূল্যায়ন করেই শেখ হাসিনা তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। বলাবলি হচ্ছিল, রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাজনীতিবিদ, আমলা না বিচারপতি কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।

সে হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু দারুণ এক প্যাকেজ, চমৎকার কম্বিনেশন। তবে আমার ধারণা আনুগত্যটাই তাঁর প্রধান যোগ্যতা। কারণ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও রাষ্ট্রপতি পদে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভিযোগ, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তাদের পক্ষে কাজ করেননি।

এবারের রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে চমক থাকলেও ঝুঁকি নেই। একটু নিভৃতচারী হলেও মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু পরীক্ষিত আওয়ামী লীগার। তবে শপথ নেওয়ার পর তিনি আর আওয়ামী লীগার থাকবেন না। তিনি হবেন রাষ্ট্রের প্রধান, সবার অভিভাবক, মহামান্য। অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সবার প্রতি ন্যায্য আচরণ করবেন। যদিও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ‘ফিতা কাটা আর মাজার জিয়ারত’ ছাড়া আর তেমন কিছু করার নেই, তবুও চাইলে রাষ্ট্রপতি অনেক কিছুই করতে পারেন।

নতুন রাষ্ট্রপতির প্রথম কাজ হলো সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন করা, জনগণের ভালোবাসা আদায় করা। মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর মেয়াদে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা তাঁর জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। তিনি যদি দুই দলের দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নিতে পারেন, যদি সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারেন, যদি একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে পারেন; তাহলেই মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জীবনের চতুর্থ অধ্যায়টিও সাফল্যে মোড়ানো থাকবে। এটুকুই শুধু প্রত্যাশা।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস